

সম্পাদক পরিচিতি
শিক্ষাচিন্তার খন্ড সমূহ
উনিশ শতককে বলা হয় বাংলার নবজাগরণের সময়, সেই সময়কলকাতায় স্থাপিত হয়েছে সংস্কৃত হিন্দু কলেজ। হিন্দু কলেজে ডিরোজিও’র (১৮০৯-১৮৩১) নেতৃত্বে সূচনা হয়েছে ইয়ং বেঙ্গলদের তান্ডব। ফলে ভারতবর্ষের স্থবির, ধ্যানমগ্ন, সংস্কারাচ্ছন্ন জীবনে তৈরি হয়েছে বিতর্ক, বিক্ষোভ। এই সময় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জ্ঞানের সমন্বয়ে বাংলায় জেগে উঠেছে আলোকিত মনীষীগণ এবং তাঁদের ধারাবাহিকতায় এসেছেন মুক্তবুদ্ধিরচর্চাকারী একদল মানুষ। এ সময়ে বাঙালি চিন্তাবিদদের মধ্যে শিক্ষা নিয়ে তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া ও মতামত লক্ষ করা যায় :এক. প্রাচ্য-পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়। এ দলে অগ্রণী ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর; দুই. প্রাচ্য কৃষ্টি ঐতিহ্য শিক্ষা ও জ্ঞানকে বাদ দিয়ে পাশ্চাত্যশিক্ষাকে গ্রহণের উন্মত্ততা। এ দলে ছিলেন ডিরোজিও, মাইকেল মধুসূদন।; তিন.পাশ্চাত্যশিক্ষার প্রতিপক্ষে প্রাচ্যবিদ্যা ও জ্ঞানের সংস্কারকে ধরে রাখার প্রয়াস। এ দলে ছিলেন রামকমল সেন, রাধাকান্ত দেব, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখ। রাজা রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের শিক্ষাচিন্তাই বাংলাভাষায় প্রবহমান থাকে। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্যরা এ চিন্তাধারাকে পরিপুষ্টি দান করেন। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা তারই উত্তরাধিকার। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গত দেড়শত বছর ধরে বাংলাভাষায় বিপুল পরিমাণে লেখালেখি হয়েছে। সেই লেখালেখির নির্বাচিত কয়েকটি প্রবন্ধ নিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে আমাদে প্রথম খন্ডটি।
১৮৩৮ সালে মেকলে তাঁর বিখ্যাত মিনিটস প্রণয়ন করেন যার ভিত্তিতে ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা হয়। তারপর বিগত দুইশত বছরে ভারতবর্ষে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার প্রসার ও পরিধি ব্যাপক ও বিশাল। ঔপনিবেশিক যে শিক্ষার উত্তরাধিকার আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা বহন করছে তার অনেক ত্রুটি ও গলদ রয়েছে। দ্বিতীয় খন্ডের লেখাসমূহে মূলত শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষানীতি, শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস ইত্যাদি প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে।
উপমহাদেশের শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, শিক্ষার বিষয়বস্তু, শিক্ষাদানের মাধ্যম, শিক্ষাদান পদ্ধতি সবকিছু নিয়েই গত দুইশত বৎসর ধরে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছে। তৃতীয় খন্ডে শিক্ষার এ সমস্যাগুলোর বিচিত্র দিক নিয়ে নানামুখী আলোচনা স্থান পেয়েছে। পাঠক এ সংকলন থেকে শিক্ষার বিগত দুইশত বৎসরের নানামুখী সমস্যার আলোচনা ও তা সমাধানের দিকনির্দেশনা দেখতে পাবেন।
এই উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমের পরিবর্তন ঘটেছে বারবার। আর্যযুগে তপোবনের শিক্ষায় শিক্ষার মাধ্যম ছিল সংস্কৃত। বৌদ্ধ শাসনামলে শিক্ষার মাধ্যম হয় পালি। আবার খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দ থেকে ১৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে প্রাকৃতের প্রাধান্য। এরপর সংস্কৃতের আধিপত্য চলে আসে, আর তা চলে দশম-একাদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। মুসলমান শাসনামলে শিক্ষার মাধ্যম হয় ফারসি ও আরবি। এ সময় মাতৃভাষাসমূহও শিক্ষায় স্থান পায়। অবশ্য জনশিক্ষায় মাতৃভাষার স্থান সবসময়ই ছিল। সংকলিত এ খন্ডে রচনাসমূহে বিগত দেড়শ বছরের বাঙালির শিক্ষার মাধ্যম বিষয়ে চিন্তার বিচিত্র প্রকাশের সন্ধান মেলে। ভাষাকে শুধু মাধ্যম হিসেবে নয়, ভাষাকে একটি শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে শিক্ষাদানের প্রসঙ্গও এখানে স্থান পেয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে স্থান পেয়েছে বাংলা বানান ও প্রযুক্তি-বিষয়ক রচনা। প্রত্যেকটি রচনায়ই শিক্ষার জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যম হিসেবে বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের অভীঞ্ঝা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে। সর্বস্তরে বাংলা, বিশেষত শিক্ষার সকল স্তরে বাংলা প্রচলনের শতাব্দীব্যাপী এ আকুলতা পাঠককে আকৃষ্ট করবে নিঃসন্দেহে।
বাঙালির উচ্চশিক্ষার গৌরব সুপ্রাচীন। আজ থেকে হাজার বছর আগে পাল-রাজাদের আমলে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর বিখ্যাত কয়েকটি বিহার বা বিশ্ববিদ্যালয়। আধুনিককালে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যে পশ্চিমা মডেল বুঝায়, এ অঞ্চলে তার সূচনা ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এ উপমহাদেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ কেমন হতে পারে বা কেমন হওয়া উচিত, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লক্ষ্য কী হতে পারে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ তার বদলে কী করছে-বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে বহুমাত্রিক রচনাসমূহ গ্রন্থে রয়েছে। গ্রন্থিত রচনায় যেমন আমাদের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে গর্ব আছে, তেমনি বর্তমান অবস্থা নিয়ে আছে হাহাকার। কোনো কোনো রচনায় উচ্চশিক্ষার সংকট নিয়ে যেমন আলোচনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে সংকট সমাধানের দিক-নির্দেশনা। এ সকল রচনার ভেতর দিয়ে পাঠক বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার একটি ঘনিষ্ঠ পরিচয় লাভ করবেন, এমনটি আশা করা যায়।
নারীশিক্ষা, বিজ্ঞানশিক্ষা, ধর্ম ও মাদ্রাসাশিক্ষা--শিক্ষার এক একটি ক্ষেত্র ও ধারা। এগুলোর প্রতিটির ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। একই সাথে এ ক্ষেত্রগুলোকে নিয়ে তর্ক-বিতর্কও চলে আসছে অনেকদিন ধরে। এই তিনটি ক্ষেত্র নিয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক কয়েকটি রচনা স্থান পেয়েছে এই খন্ডে।
প্রাচীন ভারতে যে-সকল রাজা জ্ঞানীগুণীদের কদর করতেন তাঁদের কেন্দ্র করে গুণিজনের সমাবেশ ঘটত। অধিকাংশক্ষেত্রে সেই বিদ্বান ব্যক্তিদের সমাবেশকে ভিত্তি করে পরবর্তীতে শিক্ষাকেন্দ্রসমূহও গড়ে উঠত। তক্ষশিলা, কনৌজ মিথিলা, পাটলীপুত্র, তাঞ্জোর তার প্রমাণ। এই খন্ডের কয়েকটি রচনায় রচনাগুলোতে শুধু প্রাচীন বাংলা নয়, সমগ্র ভারতবর্ষেরও বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিদ্যা ও বিদ্বানের কথা উঠে এসেছে। এর পাশাপাশি, শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মূল্যায়ন বিষয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে এই সংকলনে।
শিক্ষার ইতিহাস ও তত্ত্ব নির্মাণে শিক্ষাতত্ত্বীয় সাহিত্যের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার চিত্র আমরা পেতে পারি সাহিত্যের বিচিত্র সংরূপে। কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে, লোকসাহিত্যে, স্মৃতিকথায়। শিক্ষাচিন্তা-র এ খন্ডে আমরা শিক্ষার উনিশ শতকের ষাটের দশক থেকে বিশ শতকের নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত কালখন্ডের কয়েকটি বিশ্বস্ত সুখপাঠ্য ও গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিকথা সংকলিত করেছি। এখানে উল্লেখ্য, সময় হিসেবে শিক্ষার এ কালখ- খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার উত্থান ও পতন ঘটেছে এ সময়সীমার মধ্যেই।
শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনকে একসময় খন্ড থেকে অখন্ড, অপূর্ণ থেকে পূর্ণতায়, সীমা থেকে অসীমে, বিশেষ থেকে নির্বিশেষ চেতনায় পৌঁছানোর প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হত। আর্য ঋষি, গৌতমবুদ্ধ কিংবা অতীশ দীপঙ্করের দিকে তাকালেই তা উপলব্ধি করা যায়। তখন জ্ঞান বা শিক্ষা অর্জনের কোনো অনানুষ্ঠানিক-আনুষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক-প্রাতিষ্ঠানিক বিভাজন ছিল না। ভারতবর্ষে এ শিক্ষা-সংস্কৃতির ছাপ আমরা প্রচ্ছন্নভাবে হলেও মধ্যযুগ পর্যন্ত দেখতে পাই। মূলত শিক্ষানুরাগী, অনুশীলনীধ্যায়ী সচ্ছল সম্পন্ন, অনেক ক্ষেত্রে জমিদারশ্রেণির ব্যক্তিরাই শিক্ষার ও জ্ঞানের একনিষ্ঠ চর্চা ও ধ্যান করেছেন। কিন্তু শিক্ষা যখন প্রাতিষ্ঠানিক আকার পেতে শুরু করল, তখন থেকেই শিক্ষার স্তর-বিভাজনও শুরু হল। শিক্ষাচিন্তার এই খন্ডটিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন স্তর ও ধারা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ও চিন্তাধর্মী কিছু রচনা সংকলিত হয়েছে। আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিক, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা, শিক্ষক-প্রশিক্ষণ এবং এই স্তরগুলোর সমস্যা, শিক্ষাক্রম-পাঠ্যসূচি-পাঠপুস্তক ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে আমাদের পান্ডিতজনদের লেখা এতে স্থান পেয়েছে। তাঁদের চিন্তার মাত্রিকতা ও ব্যাপকতা আমাদের বিস্মিত করে। আশা করি আমাদের শিক্ষার বিভিন্ন স্তর ও ধারা সম্পর্কে এ লেখাগুলো পাঠকের নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে।