

সম্পাদক পরিচিতি
চলচ্চিত্রচিন্তার খন্ড সমূহ
চলচ্চিত্রকলার উদ্ভব ও বিকাশ- চলচ্চিত্রকলা, শতবর্ষ-পেরোনো সর্বকলা আত্তীকৃত এক শিল্প, যোগাযোগ ও প্রকাশমাধ্যম। বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ওপর এই মাধ্যমের আত্মপ্রকাশ নির্ভরশীল ছিল। ‘বাঙালির চলচ্চিত্রচিন্তা’ শীর্ষক সংকলনযজ্ঞের প্রথম খন্ডে চলচ্চিত্র একটি ‘কলারূপ’ হিসেবে কীভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, সে-বিষয়ে সুচিন্তিত বিবরণসমৃদ্ধ কয়েকটি রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যাতে পাঠক এই কলারূপের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা পেতে পারেন। তাছাড়া, এই কলারূপের উপকরণের বিশেষত্বসমূহও চিহ্নিত হয়েছে বেশ কয়েকটি রচনায়। তানভীর মোকাম্মেল, অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়, মৈনাক বিশ্বাস, তারেক মাসুদ, মির্জা তারেকুল কাদের, নরেন্দ্র দেব ও আবদুস সেলিমের রচনা পাঠে চলচ্চিত্রকলার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের সূত্র সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। চলচ্চিত্রকলার সংজ্ঞা, প্রকৃতি ও প্রভাব; ভাষা হিসেবে এই কলার বিবর্তনের স্বরূপ; চলচ্চিত্র সম্পাদনার রীতিসমূহ কীভাবে চলচ্চিত্রভাষার নিজস্ব ব্যাকরণের জন্ম ও বিকাশ ঘটাল-- সেসব বিষয়ও জানা যায় উল্লিখিত লেখকদের রচনা থেকে। তাঁদের রচনায়, বিশেষভাবে ১৯৩৪ সালে রচিত কবি নরেন্দ্র দেব-এর রচনা থেকে জানা যায় যে, চলচ্চিত্রকে একটি সম্পূর্ণ কলা হয়ে উঠতে হলে এই মাধ্যমে ‘কলাভিজ্ঞ’ ব্যক্তির সম্পৃক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা
‘বাঙালির চলচ্চিত্রচিন্তা’র দ্বিতীয় খন্ড ‘চলচ্চিত্রের কলারূপ’। এই খন্ডে এমন সব রচনা একত্র করা হয়েছে যেগুলো প্রধানত চলচ্চিত্রের আভ্যন্তরীণ উপকরণসমূহকে গুরুত্ব দিয়ে রচিত। চলচ্চিত্রের সৌকর্য অন্বেষণ করতে যে-তত্ত্ব তৎপর হয়, তাকে বলা যায় ‘চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব’। চলচ্চিত্র নির্মাণের তিনটি পর্যায় আছে : শুটিং-পূর্ব-পর্যায়; শুটিং-পর্যায় ও শুটিং-উত্তর-পর্যায়। চলচ্চিত্রসৃষ্টির তিনটি পর্যায়ে নানাবিধ উপকরণের আলোচনা আছে এই খন্ডে।
বর্তমান খন্ডের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত চলচ্চিত্রবিষয়ক একটি নাতিদীর্ঘ পত্রপ্রবন্ধ স্থান পেয়েছে যা থেকে চলচ্চিত্রের ‘কলারূপ’ সম্পর্কে তাঁর অভিমত জানা যায় ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন তাঁর ভ্রাতা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরও চলচ্চিত্রকলা সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন। দেবীপ্রসাদ ঘোষের রচনা থেকে চলচ্চিত্রের অভ্যন্তর-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাঁর মতামত জানা যায়। কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও চলচ্চিত্রতাত্ত্বিক পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় চলচ্চিত্র ও থিয়েটারযজ্ঞের মধ্যে উপকরণগত ভিন্নতা আলোচনা করেছেন; এই দুয়ের মধ্যে ঐক্য ও অনৈক্যের দিকগুলো চিহ্নিত করেছেন
চলচ্চিত্রসৃষ্টিতে ব্যবহৃত হয়েছে তা ‘সেট’ ও ‘স্থাপনা’-র প্রসঙ্গ এনে বুঝিয়ে দিয়েছেন। চলচ্চিত্রশিল্পের স্বভাব-সংগঠনে নাটক, সংগীত, সাহিত্য, চিত্রকলা প্রভৃতির অবদান নিরূপণ করেছেন। দর্শকের মধ্যে চলচ্চিত্র দুটি দিক থেকে সংবাহিত হয় : দৃষ্টি ও শ্রুতি। এই দুটি দিককে ঘিরে যেসব শিল্পাঙ্গিকের জন্ম হয়েছে
চলচ্চিত্রের কলারূপ অন্বেষণ করতে হলে চলচ্চিত্রের নন্দনরূপ আলোচনায় আনতেই হবে। অরুনেন্দু দেব এই কাজটি করে লিখেছেন যে ‘চলচ্চিত্র বহু শিল্পের জারকরসে উজ্জীবিত নবতর একটি এবং শিল্পবিচিত্রার বহুভঙ্গিমার মহাসঙ্গম।
‘বাঙালির চলচ্চিত্রচিন্তা’ শীর্ষক সংকলনযজ্ঞের তৃতীয় খন্ড ‘চলচ্চিত্রের প্রকাশশৈলী’।
বর্তমান খন্ডের প্রথম লেখা সত্যজিৎ রায়ের ‘চলচ্চিত্র-রচনা : আঙ্গিক, ভাষা ও ভঙ্গি’ থেকে চলচ্চিত্র-রচনায় সাধারণভাবে মান্য প্রক্রিয়া বা পর্যায়সমূহ সম্পর্কে জানা যায়। পর্যায়সমূহের নানা দিক সাঙ্গ করার ধরনের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় চলচ্চিত্রকারের প্রকাশশৈলী। সত্যজিতের বিবেচনায় এর তিনটি দিক হচ্ছে : চিত্রনাট্য রচনা, দৃশ্যসমূহ ধারণ ও খন্ডে-খন্ডে ভাবে তোলা দৃশ্যসমূহ চিত্রনাট্য অনুসারে গুছিয়ে সাজানো। পরের রচনা ঋত্বিক ঘটক বিরচিত ‘দুই দিক’। চলচ্চিত্রসৃষ্টির জন্য দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন লেখক : শিল্পবোধ ও নির্মাণশৈলী। এই দুটি দিকের ওপরই নির্ভর করে চলচ্চিত্রকারের প্রকাশশৈলী। চলচ্চিত্র বস্তুত একটি প্রকাশই, ভাষা ও আঙ্গিক তো বটেই। ঋত্বিকের বিবেচনায় চলচ্চিত্রসৃষ্টির ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রনির্মাতাকে শট, ফোকাস, কম্পোজিশন, ট্রাকিং, জুম, সম্পাদনা ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতেই হবে। মৃণাল সেন তাঁর রচনায় চলচ্চিত্রের প্রকাশশৈলী চলচ্চিত্রকার কর্তৃক সৃষ্ট মন্তাজ-পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করেন। ধীমান দাশগুপ্ত বিষয়টি তাঁর ‘ইমেজ, মন্তাজ ও কম্পোজিশন’ শীর্ষক রচনায় বিশদ করেছেন। তিনি চলচ্চিত্রকার কর্তৃক সৃষ্ট চিত্রপ্রতিমার মধ্য দিয়ে কীভাবে চলচ্চিত্রের প্রকাশশৈলী গড়ে ওঠে তা সবিস্তার আলোচনা করেছেন। ‘চিত্রভাষা : মন্তাজ’-এ দিলীপ মুখোপাধ্যায় মন্তাজপ্রসঙ্গকে আরো সম্প্রসারিত করেছেন। তিনি চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা-যে প্রধানত চিত্র বা দৃশ্যমাত্রাগত ইমেজনির্ভর, সে-বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আইজেনস্টাইনের মন্তাজতত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন এবং চলচ্চিত্রভাষার স্বরূপ ও প্রকৃতি নির্ণয় করেছেন। তাঁর আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, চলচ্চিত্রের প্রকাশশৈলী বহুলাংশেই মন্তাজ-পদ্ধতি দ্বারা নিরূপিত হয়।
পরবর্তী রচনা ঋত্বিক ঘটকের ‘পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র’। লেখকের মতে চলচ্চিত্র নামক প্রকাশমাধ্যমকে তিন দিক থেকে ভাগ করা যেতে পারে : যান্ত্রিক, আঙ্গিকগত এবং শৈল্পিক। সবদিক থেকেই চলচ্চিত্রকলার প্রকাশশৈলী বিকশিত হতে পারে বলে ঋত্বিকের অভিমত। সত্যজিৎ রায় তাঁর রচনা ‘চলচ্চিত্র-চিন্তা’য় নির্বাক (নিঃশব্দ) ও সবাক (সশব্দ) চলচ্চিত্রের প্রকাশভঙ্গি শৈলীগতভাবে ভিন্ন বলে মত দিয়েছেন। কারণ উভয়ের নন্দনতাত্ত্বিক পরিকাঠামো ভিন্ন।
বর্তমান খন্ডের শেষদিকে তথ্যচিত্র-প্রামাণ্যচিত্রের বিষয়ে চারটি রচনা স্থান পেয়েছে।
একটি প্রশ্ন দিয়ে চতুর্থ খন্ডের ভূমিকা শুরু - একটি ভূখন্ডের চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাস রচনার ভৌত উপাদানসমূহ কী কী হতে পারে? এককথায় এর উত্তর হয় না, কারণ, একটি ভূখন্ডের চলচ্চিত্রশিল্পের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত বহু উপাদানবিশিষ্ট হতে পারে। যেমন : প্রথম প্রদর্শন, স্টুডিও নির্মাণ, সিনেমাহল নির্মাণ, বিতরণ ও প্রদর্শন-ব্যবস্থা, সংবাদপত্রে প্রকাশিত চলচ্চিত্রবিষয়ক সংবাদ, স্টুডিওর দলিল-দস্তাবেজ, স্থিরচিত্র, চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন, চলচ্চিত্রের পোস্টার, চলচ্চিত্রের গানের বই, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অর্জনের স্মৃতিকথা (ডায়েরি, সাক্ষাৎকার, আত্মজীবনী ইত্যাদি), চলচ্চিত্র-নির্মাণ ও প্রদর্শন সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি, টিকেট, চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত নীতিমালা, সেন্সর বিষয়ক সরকারি নীতিমালা ইত্যাদি। উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখেই বর্তমান খন্ডের রচনাগুলো নির্বাচন করা হয়েছে।
ত্রিশ-চল্লিশ দশকের নিঃশব্দ ও সশব্দ চলচ্চিত্রের বিষয় ও আঙ্গিক সম্পর্কে লেখক তাঁর সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন। ওই সময়কার বাংলা চলচ্চিত্রে সামাজিক, পৌরাণিক ও ধর্মমূলক বিষয় বেশি থাকত এবং করণকৌশলে হলিউডের চলচ্চিত্র ও সমকালীন বাংলা থিয়েটারের ছাপ ছিল বলে সত্যজিৎ রায় মন্তব্য করেছেন। চল্লিশের দশকে বিমল রায়, নীতিন বোস, হেমেন গুপ্ত, সত্যেন বসু, নির্মল দে প্রমুখ চলচ্চিত্র নির্মাণভাবনায় প্রথম বাঙালি মেজাজ আনেন ।
মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির সামাজিক ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর অথচ গৌরবদীপ্ত সময়ের বয়ান- চলচ্চিত্রকলায় সেই সময়ের নানাবিধ দিক ও চিহ্ন রূপায়িত হয়েছে যুদ্ধ চলাকালীন ও পরবর্তী পর্যায়ে।
দুই বাংলার চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে যাঁরা চলচ্চিত্রকলাকে তাঁদের ভাব-বক্তব্য প্রকাশ করার জন্য একটি শিল্পমাধ্যম বলে গণ্য করে চলচ্চিত্র সৃষ্টি করেছেন, তাঁদেরকেই ‘বাংলা চলচ্চিত্রের স্রষ্টা’ বলা হয়েছে। এঁরা চলচ্চিত্রশিল্পের ‘কলারূপ’কে আমলে এনে এই কলাকে ঋদ্ধ করেছেন; এর আঙ্গিক-ভাষার পরিধিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং একই সাথে বাংলা চলচ্চিত্রকে বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে স্থাপন করেছেন। এঁরা একদিকে যেমন বাংলা সাহিত্যের মহৎ গল্প-উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ দিয়েছেন, অন্যদিকে সময়ের প্রয়োজনে তাঁদের স্ব-সময় ও সমাজের জ্বলন্ত সমস্যাকে ভিত্তি করে নিজেরাই কাহিনি রচনা করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ফলে কখনো কখনো তাঁদের সৃষ্ট চলচ্চিত্রকর্ম উপন্যাসের সমকক্ষ-প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে।
পঞ্চম খন্ডের প্রথম রচনাটি ঋত্বিক ঘটকের। ঋত্বিকের বিবেচনায় ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) সত্যজিৎ রায়কে ‘নবযুগের স্রষ্টার আসনে বসিয়ে দিল, যে আসন থেকে ওঁকে সরাতে কোনোদিনই কেউ পারবে না।’ ঋত্বিক লিখেছেন, ‘বিশেষ একটা কিছু’ না-থাকলে জাতশিল্পী হওয়া যায় না যা সত্যজিতের মধ্যে ছিল। সত্যজিৎ সম্পর্কিত খ-ভুক্ত রচনাগুচ্ছে লেখকগণ এই ‘বিশেষ একটা কিছু’-র সন্ধান করেছেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে - সত্যজিতের জীবনদর্শন, বিশ্ববীক্ষা, চলচ্চিত্রকর্ম, চলচ্চিত্র নির্মাণশৈলী, সমাজভাবনা প্রভৃতি বীক্ষণপূর্বক।
ষষ্ঠ খন্ডে চলচ্চিত্রবীক্ষণের নন্দনতত্ত্বের নানা দিক নিয়ে রচিত কয়েকটি রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যাতে চলচ্চিত্রনিরীক্ষণ-সমীক্ষণ-বীক্ষণের সংজ্ঞার্থ বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সৎ, শুদ্ধ ও নির্মল চলচ্চিত্রের ওপর রচিত উল্লেখযোগ্য ও মানসম্পন্ন রচনা (যতটা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে) সংকলিত হয়েছে। বীক্ষণসমূহ সাজানো হয়েছে যে-চলচ্চিত্রের ওপর বীক্ষণকর্মটি, সেই চলচ্চিত্রের নির্মাণকালকে মুখ্যসূচক ধরে অর্থাৎ বীক্ষণকর্মকে সংকলনভুক্ত করার ক্ষেত্রে নির্মাণকালের অনুক্রমকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে- সবচেয়ে পুরনো চলচ্চিত্রটিকে প্রথমে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে, তা ওই চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে যখনই বীক্ষণকর্মটি রচিত হোক-না কেন। বলা দরকার যে, খ-দ্বয়ের জন্য রচনা সংগ্রহ করতে গিয়ে বহু রচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে যার অধিকাংশ প্রতিবেদনধর্মী (বাংলাদেশের ক্ষেত্রে), বেশকিছু চলচ্চিত্রবীক্ষণমূলক, আবার অল্পকিছু ‘চলচ্চিত্র-পাঠ’ বলতে যা বোঝায়, সে-রকম।
‘বাঙালির চলচ্চিত্রচিন্তা’ শীর্ষক সংকলনযজ্ঞের ষষ্ঠ খ-টির মতো সপ্তম খন্ডের শিরোনামও ‘বাংলা চলচ্চিত্রবীক্ষণ’। সচরাচর এটা লক্ষ করা গেছে যে, নির্মিত-প্রদর্শিত সব চলচ্চিত্রই সমালোচকদের লেখার ব্যাপারে উৎসাহী করে তোলে না। যে-চলচ্চিত্র সমালোচককে নাড়া দেয়, ভাবায়-- সাধারণত সেই চলচ্চিত্র নিয়েই তিনি লিখে থাকেন। তখন তিনি চলচ্চিত্রকলা ও জ্ঞানকা-ের অন্যান্য শাখা থেকে অধীত বিদ্যা দিয়ে চলচ্চিত্রটির শিল্পমূল্য বিচার করে থাকেন। এই খন্ডে গ্রহিত উভয় বাংলার সমালোচকদের রচনাসমূহে তার প্রমাণ মিলবে।
অষ্টম খন্ড ‘বিশ্ব চলচ্চিত্র’। বিশ্বের নানা দেশের চলচিত্রস্রষ্টারা নান্দনিক মূল্যসমৃদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে চলচ্চিত্রকলাকে ঋদ্ধ করেছেন। এইসব চলচ্চিত্র-দর্শনে বাঙালি সাহিত্যিক-চলচ্চিত্রনির্মাতা-চলচ্চিত্র সমালোচকদের নির্বাচিত কিছু রচনা স্থান পেয়েছে বর্তমান খন্ডে।
চলচ্চিত্রকলা ধীরে ধীরে একটি ভাষা, একটি প্রকাশমাধ্যম হয়ে উঠেছে। এই সংগঠন-প্রক্রিয়া সাঙ্গ করেছেন চলচ্চিত্রস্রষ্টাগণই, তাঁদের নির্মিত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। নিঃশব্দ যুগেই চলচ্চিত্রের আঙ্গিক নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা হয়। এর ফলে চলচ্চিত্রাঙ্গিকের পরিধির বিস্তৃতি ঘটে। এই বিস্তৃতির পিছনে নানা জাতের শিল্পান্দোলন প্রভাব ফেলেছে। যেমন চিত্রকলায় সংগঠিত এক্সপ্রেশনিজমের আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো গত শতাব্দীর বিশের দশকের শুরুতে যখন জার্মান চলচ্চিত্রে প্রয়োগ করা হয়, তখন চলচ্চিত্রের প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রে নবতর এক প্রকাশশৈলীর আবির্ভাব ঘটে। তানভীর মোকাম্মেল তাঁর রচনায় ১৯১৯ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত নির্মিত জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট চলচ্চিত্রসমূহের আলোচনা করতে গিয়ে সেইসব চলচ্চিত্র নির্মাণের পটভূমি, এগুলোর বিষয় ও নির্মাণশৈলী বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন।
বুদ্ধদেব বসু ১৯৪৯ সালে একই চলচ্চিত্রের ওপর লিখতে গিয়ে চ্যাপলিনকে শিল্পের স্রষ্টা বলে অভিহিত করেন এবং তাঁর শিল্পকর্মকে শেক্সপিয়রের শিল্পকর্মের মতো বহুস্তরবিশিষ্ট বলেছেন। শতদ্রু চাকীও বলেন যে, চ্যাপলিন হাস্যরসের মাধ্যমে আমেরিকান সমাজের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। যুদ্ধ শেষ হলেও কেন ব্যবসায়ীরা পুনরায় যুদ্ধের আয়োজন করে, চ্যাপলিন তাই দেখিয়েছেন এ চলচ্চিত্রে। চ্যাপলিন বস্তুত তাঁর চলচ্চিত্রে এ বক্তব্যই প্রতিস্থাপন করেছেন যে, যতদিন ব্যবসা থাকবে, ততদিন ‘যুদ্ধ’ থাকবে, ততদিন অস্ত্রের ব্যবসাও থাকবে। বিবেচনাটি বস্তুত কাল মার্কসের। তিনি বলেছিলেন যে, শিল্প তথা ব্যবসা চালু রাখতে হলে যুদ্ধের প্রয়োজন পড়বেই।
বিশ্ব-চলচ্চিত্র বহু ধারা-বহু ভাবনায় নিজেকে সজ্জিত করেছে-- এ কথা বলার মতো অনেক রচনা মনে হয় বর্তমান খন্ডে জড়ো করা গেছে। তবু বিশ্ব-চলচ্চিত্র যে বহুভঙ্গিম এবং বহুধারায় বিন্যস্ত-- তার যৎসামান্যই এ খন্ডে স্থান পেয়েছে। সব রচনা সংগ্রহ করা ও খন্ডভুক্ত করা সম্ভবও নয়। কিন্তু এটা তো পরিষ্কার যে, বাঙালি চলচ্চিত্রচিন্তকগণ বিশ্ব-চলচ্চিত্রের নানা দিক নিয়ে ভেবেছেন- লিখেছেন।
এ খন্ডের আলোচনা ‘বিশ্ব চলচ্চিত্রকার’। বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র-রচয়িতা সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রবিশেষজ্ঞরা যেসব রচনা লিখেছেন, সেসবের নির্বাচিত অংশ চয়ন করা হয়েছে।
প্রথম রচনা মার্কিন চলচ্চিত্রকার ডি. ডব্লিউ. গ্রিফিথের (১৮৭৫-১৯৪৮) ওপর, ভিয়েনায় জন্ম নেওয়া মার্কিন চলচ্চিত্রকার এরিখ ফন স্ট্রোহাইমও (১৮৮৫-১৯৫৭) চলচ্চিত্রভাষার উন্নয়নে অবদান রেখেছেন। রজত রায় তাঁর রচনায় স্ট্রোহাইম কেন গ্রিফিথের মন্তাজরীতির বদলে ‘প্ল্যান সিকোয়েন্স-রীতি’র প্রচলন করেন, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ‘ডিপ ফোকাস’-এর ব্যবহারের মাধ্যমে স্ট্রোহাইম চলচ্চিত্রভাষার উন্নতি করেছেন বলে লেখকের অভিমত। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় নিঃশব্দ যুগের চলচ্চিত্রকার বাস্টার কিটন (১৮৯৫-১৯৬৬) সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
বিশ্বের নানা দেশের চলচ্চিত্রকারদের সৃষ্ট নানামুখী চলচ্চিত্রের মধ্যেই খুঁজতে হবে চলচ্চিত্রকলার প্রকৃত বহুমুখিন ইতিহাস। বলা চলে যে, চলচ্চিত্রকলার ইতিহাস হচ্ছে এই মাধ্যম নিয়ে চলচ্চিত্রকারদের নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ইতিহাস।
আবার কোনো একক ভাবনার নিরিখে একগুচ্ছ চলচ্চিত্র নির্মিত হওয়ার পর তাদের একটি শিল্প-মতবাদের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। যেমন নব্য-বাস্তববাদ-- দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইতালিতে তৈরি কিছু চলচ্চিত্র বীক্ষণ করে সমালোচকেরা এই নাম দিয়েছেন। চলচ্চিত্র-মাধ্যমই কি তাহলে এই নব্য-বাস্তবতাবোধের জন্ম দেয়!
‘বাঙালির চলচ্চিত্রচিন্তা’ শীর্ষক সংকলনযজ্ঞের দশম তথা শেষ খ- ‘বিশ্ব চলচ্চিত্রধারা’। যেসব দেশে বিভিন্ন চলচ্চিত্রধারার উদ্ভব, বিকাশ ও পতন ঘটেছিল সেসব দেশের চলচ্চিত্রধারাকে প্রাধান্য দিয়ে লেখা নির্বাচিত রচনা এ খন্ডে স্থান পেয়েছে। ‘বাঙালির চলচ্চিত্রচিন্তা’ সংকলনের অষ্টম খন্ড ‘বিশ্ব চলচ্চিত্র’, নবম খন্ড ‘বিশ্ব চলচ্চিত্রকার’ ও দশম খন্ড ‘বিশ্ব চলচ্চিত্রধারা’ মিলে একটি ত্রয়ী হয়ে উঠেছে। তিনটি খন্ডেরই মূল বিষয় বিশ্ব-চলচ্চিত্রের নানাদিক। বাঙালি চলচ্চিত্রচিন্তকগণ বিশ্ব-চলচ্চিত্র সম্পর্কে যা লিখেছেন তার কিছু অংশ জড়ো করা হয়েছে দশম খন্ডে।
চলচ্চিত্রধারা সৃষ্টিতে জাপানের নাম সরাসরি উচ্চারিত না-হলেও এদেশে অনেক কালজয়ী চলচ্চিত্র সৃষ্টি হয়েছে এবং জাপানি চলচ্চিত্রের কিছু ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তীকালে এদেশে নব্য-বাস্তববাদী চলচ্চিত্রধারার সূচনা হয়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এদেশে একক চলচ্চিত্রস্রষ্টাদের নির্মিত চলচ্চিত্রই বিশ্বব্যাপী আদৃত হয়, এঁদের চলচ্চিত্রগুচ্ছকে কোনো বিশেষ চলচ্চিত্রধারাভুক্ত করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকেরই, বিশেষ করে ওজু, ওশিমা, কুরোশাওয়া প্রমুখের চলচ্চিত্র স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের কারণেই স্ব-স্ব ধারাভুক্ত হয়ে আছে। এর কারণ হচ্ছে এঁদের প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব নির্মাণশৈলী এবং কাহিনি-উপস্থাপনের অননুকরণীয় প্রকাশভঙ্গি।