Arthoniti Chinta
Arthoniti Chinta

সম্পাদক পরিচিতি

সংগীতচিন্তার খন্ড সমূহ

বাঙালির সংগীতচিন্তা-বিষয়ক রচনা সংকলনের প্রথম খন্ডে কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত গীতসূত্রসার, অমিয়নাথ সান্যাল রচিত প্রাচীন ভারতের সংগীতচিন্তা ও আবদুশ শাকুর রচিত সংগীত সংবিৎ গ্রন্থের কয়েকটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হল। ‘বাঙালির সংগীতচিন্তা’ গ্রন্থটির মূল ভূমিকায় এক ধরনের জরিপ ও পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করা হয়েছে। এ চিন্তার উৎপত্তি কখন, কীভাবে, কোন্ কোন্ প্রধান চিন্তাবিদের রচনা অবলম্বনে এর বিকাশ, সে সম্পর্কে ভূমিকায় সবিস্তার আলোচনা করা হয়েছে। গীতসূত্রসার দিয়েই সংকলনের সূচনা। কেননা কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বপ্রথম এই গ্রন্থে বাংলায় বিবরণমূলক সংগীতালোচনাকে চিন্তাপ্রবণ করে তোলার সাধ্যমতো চেষ্টা করেন। কাজটি সহজ ছিল না। শত শত বছর ধরে রাগসংগীতের যে বিবরণসর্বস্ব আলোচনার ধারা গড়ে উঠেছিল ভারতবর্ষে, সেই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে তাকে চিন্তাভিমুখী করে তোলা সহজ কাজ নয় মোটেই। তা-ও উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, সংগীত যে চিন্তনীয় বিষয়, শুধুই বিবরণীয় নয়, তখনো এমন ভাবনা ভারতবর্ষের কোথাও সংহত হয়ে ওঠেনি। 

বাংলা গান বলতে আমরা এর প্রধান যে প্রবাহ বা নাগরিক গতিপ্রবাহকে বুঝাই, যার বিবর্তনের একটি প্রামাণ্য রূপরেখা আমরা দাঁড় করাতে পারি, তার সঙ্গে বাংলার অঞ্চলাতিয়েক সংগীতের যোগাযোগ প্রবল। মধ্যযুগের সর্বভারতীয় প্রবন্ধসংগীত এবং আধুনিক যুগের হিন্দুস্তানি সংগীতপ্রবন্ধের দৃষ্টান্তেই বাংলা নাগরিক সংগীতের বিকাশ। এ গানের ভাষা বাংলা, কিন্তু সংগীতের ক্ষেত্রে তা চর্যা বা ধ্রুব শ্রেণির মধ্যযুগীয় সর্বভারতীয় প্রবন্ধসংগীত এবং আধুনিক কালের ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুংরি প্রভৃতি হিন্দুস্তানি প্রবন্ধকে অবলম্বন করে এগিয়েছে। বাংলা গানের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, এর বিবর্তনের একটি আঞ্চলিক স্বভাব আছে। কিন্তু সব কিছুকেই অনুধাবন করতে হবে ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতের বিনাশের পটভূমিতে। তা না হলে বাঙালির সংগীত-সুকৃতির মূল বৈশিষ্ট্যকে বা হিন্দুস্তানি গানের ধারা থেকে এর পার্থক্যের স্বরূপটিকে বোঝা যাবে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই প্রথম খ-টিকে প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে পৃষ্ঠাসংখ্যা মিলিয়ে খন্ডের কলেবর-সাযুজ্য বজায় রাখার জন্যে অন্য কতিপয় খন্ডের মতো খানিক ব্যতিক্রম থাকতে পারে। তবে মূলত ঐতিহাসিকতার ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 

এ ঘটনাটি খুবই গৌরবের যে, হিন্দুস্তানি সংগীতচর্চার অ্যাকাডেমিক ভিত্তিটি গড়ে দিয়েছেন যে মহাপন্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডে, তিনি গীতসূত্রসার গ্রন্থটি পড়ার জন্যেই বাংলা ভাষা শিখেছিলেন। 

দ্বিতীয় খন্ডে রবীন্দ্রনাথের ‘সংগীতচিন্তা’র নির্বাচিত অংশ, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘কথা ও সুর’ এবং তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘বক্তব্য’ থেকে দুটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করা হল। রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তা এখানকার মুখ্য ব্যাপার। ধূর্জটিপ্রসাদের প্রবন্ধাবলি অনেকটা এর পরিপূরক কাজ। ‘বাঙালির সংগীতচিন্তা’ শিরোনামে সকল খন্ডের অগ্রবর্তী ভূমিকা হিসেবে যে প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে, বাংলা গান নিয়ে বা বাঙালির সংগীত রচনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথই প্রথম যথার্থ চিন্তামূলক আলোচনার সূত্রপাত করেন। বাংলা গানের প্রকৃত সৌন্দর্যের স্বরূপ যে কী, এবং হিন্দুস্তানি সংগীতরীতি থেকে বঙ্গীয় নাগরিক সংগীতরীতির পার্থক্যের বিষয়টি যে কোথায় নিহিত, এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সংগীত-বিষয়ক চিন্তামূলক লেখার ওপর দীর্ঘকাল ধরে আলোচনা  চলেছে। প্রায় ষাট বছর ধরে প্রবন্ধে, অভিভাষণে, পত্রে, স্মৃতিচারণে রবীন্দ্রনাথ অক্লান্তভাবে বাংলা গানের বৈশিষ্ট্য এবং রাগসংগীতের বৈশিষ্ট্য নিয়েও মত প্রকাশ করেছেন। দিলীপকুমার রায় ও ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও সংগীতের নানা বিষয়ে তিনি মত বিনিময় করেছেন। আজকে আমরা বাংলা গানের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে কথা বলতে পারছি এবং হিন্দুস্তানি সংগীতরীতির ভেতরে থেকেও বাংলা গান মেজাজে-মননে পৃথক বলে যে ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারছি, তার পটভূমিতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তা।  হিন্দুস্তানি সংগীত চর্চার ভরা যুগে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। ঠাকুর পরিবারের উচ্চ হিন্দুস্তানি সংগীত চর্চার আদলে তাঁর সংগীতমানস গঠিত। এর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে তিনি যেভাবে বাংলা গানের পৃথক নন্দনরূপটিকে দাঁড় করালেন এবং তার একটি প্রাতিষ্ঠানিক পটভূমি গড়ে তুললেন, একক চেষ্টায় সে কাজের দৃষ্টান্ত জগতে বিরল। রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণ বাংলা গানের স্বরূপ বুঝতে সাহায্য করে। তাঁর নিজের গানকে বুঝতে যে সাহায্য করে সে কথা বলাই বাহুল্য। ধূর্জটিপ্রসাদের সংগীত-বিষয়ক প্রবন্ধাবলি রবীন্দ্রসংগীত এবং সাধারণভাবে বাংলা কাব্যসংগীতের সৌন্দর্য ব্যাখ্যানে সহায়ক হয়। 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের এবং ভারতীয় সংগীত রচনার রীতি-প্রকৃতি নিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কয়েকজন মনীষীর সঙ্গে কথা বলেছেন। দিলীপকুমার রায় বা ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যখন সংগীত বিষয়ে কথা বলেন তখন তিনি যেভাবে বক্তব্য বিষয় ব্যাখ্যা করেন, আইনস্টাইনের সঙ্গে কিন্তু কিঞ্চিৎ পৃথকভাবে কথা বলেন এবং আগে না বলা কিছু বিষয়ও উপস্থাপন করেন। সে বিবেচনায় বিদেশি মনীষীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সংগীত বিষয়ে মত বিনিময়সমূহও এখানে রাখা হয়েছে।  


তৃতীয় খন্ডে দিলীপকুমার রায়ের ‘সাঙ্গীতিকী’, অরুণ ভট্টাচার্যের ‘সঙ্গীতচিন্তা’ ও অমিয় রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সংগীতের শিল্পদর্শন’ গ্রন্থসমূহ থেকে নির্বাচিত রচনা অন্তর্ভুক্ত হল। বাঙালির সংগীতচিন্তার বিকাশে রবীন্দ্রনাথ-দিলীপকুমার-ধূর্জটিপ্রসাদ মহাত্রয়ীর অবদান সম্পর্কে অনিবার্যভাবেই উল্লেখ করা হয়। ‘বাঙালির সংগীতচিন্তা’ প্রবন্ধেও এ ব্যাপারে নাতিবিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। দিলীপকুমার রায় ছিলেন স্বয়ং গীত রচয়িতা, সুরকার, গায়ক, প্রশিক্ষক ও সংগীতজ্ঞ। রাগসংগীত বলে কথা নয়, বিশ্বসংগীত সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল ব্যাপক ও গভীর। রাগসংগীতে তিনি ঘরানাদারি ওস্তাদদের দেওয়া তালিমে তাঁর অসামান্য গায়কী জীবন গড়ে তুলেছিলেন। পাশ্চাত্যসংগীতেও তাঁর শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ছিল উচ্চমানের। এসব মিলিয়ে দিলীপকুমার অসাধারণ সংগীতালোচক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। হিন্দুস্তানি সংগীতশৈলীর প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল এবং গানে সুরবিহারের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্কে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের ধারণাকেই তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং সেই স্বীকৃতিকে ব্যাখ্যাও করেছিলেন অসাধারণ বাকভঙ্গিতে। দিলীপকুমার রায় বাংলা গান এবং বাংলা গানের সঙ্গে যুক্ত বিষয়াদিকে ব্যাখ্যা করেছেন নিজের সৃজনশীল ও চিন্তাশীল বুদ্ধি দিয়ে। সে এক অপূর্ব বস্তু হয়ে উঠেছে। বাঙালির সংগীতচিন্তার অনুধাবন দিলীপকুমার রায়ের রচনা পাঠ ব্যতীত সম্পূর্ণ নয়। অরুণ ভট্টাচার্য রাগসংগীত ও রবীন্দ্র--উভয় বিষয়েই তাঁর সুচিন্তিত মতের উপস্থাপনা দ্বারা বাঙালি সংগীতামোদী সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বর্তমান খন্ডে অন্তর্ভুক্ত তাঁর রচনায় রাগসংগীত সম্পর্কে তাঁর যে-সব পর্যবেক্ষণ পাওয়া যাবে, তা বাংলা গানের স্বরূপ অনুধাবনেও সহায়ক হবে। বাংলা গান হিন্দুস্তানি গানের সৌন্দর্যকে বহন করে, তবে ঈষৎ পৃথকভাবে। আর সংগীতের সৌন্দর্যদর্শন বলে যে বিষয়টি আছে সে সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন ড. অমিয় রঞ্জন। তিনি ঘরানাদার গায়ক, প্রশিক্ষক ও গবেষক। সংগীত তো উপস্থাপনারই বিষয়। তবে উপস্থাপনা যথার্থ হবে না, যদি-না সে সৌন্দর্যচিন্তার সমর্থন পায়। অমিয় রঞ্জনের শিল্পদর্শনমূলক লেখার নির্বাচিত অংশকে এই সঙ্গে গ্রথিত করা হল এই ভেবে যে, এ থেকে চিন্তামূলক সংগীতালোচনার দার্শনিক পটভূমিটি সম্পর্কে পাঠকদের ধারণা স্পষ্ট হবে। বাংলা সংগীতের শিল্পদর্শন বা নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে বেশ কিছু বই লেখা হয়েছে। তবে সেসব থেকে অমিয় রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজকেই আমরা অগ্রগণ্য বিবেচনা করেছি। প্রথম তিন খন্ডে বলতে গেলে সংগীত বিষয়ে বাঙালির চিন্তার একটি সাধারণ রূপের পরিচয় পাওয়া যাবে।  

এই খন্ডে রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে চিন্তামূলক রচনা সংকলিত করা হল। রবীন্দ্রনাথ নিজে বাংলা গান ও তাঁর নিজের গান সম্পর্কে জীবনব্যাপী অক্লান্তভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। রবীন্দ্র-বক্তব্যে রবীন্দ্রসংগীত ব্যাখ্যাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও চিত্তাকর্ষক। সেসব বক্তব্য একত্র করে বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ থেকে ‘সংগীতচিন্তা’ নামে একটি বই বের করা হয়েছে, তবে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক পরে। এর আগে থেকেই রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে চিন্তামূলক রচনা ও গ্রন্থ প্রকাশ শুরু হয়ে গেছে। শুরু থেকে অদ্যাবধি রবীন্দ্রসংগীত চর্চার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত আছেন, তাঁদের অনেকেই বোধবুদ্ধিতে অগ্রসর। তাঁদের অনেকেই রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। সর্বাগ্রে নাম করতে হয় শান্তিদেব ঘোষের। একেবারে শিশুবেলা থেকে শান্তিনিকেতন আশ্রমে তিনি বেড়ে উঠেছেন। রবীন্দ্রনাথের আদর্শে ও নির্দেশনায় এবং পৃষ্ঠপোষকতায় গায়ক, নর্তক ও প্রশিক্ষক হিসেবে নিজের জীবনকে বিকশিত করে তুলেছেন। রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে চিন্তামূলক গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রেও তাঁর নামই আসে সর্বাগ্রে। ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে ‘রবীন্দ্রসংগীত’ নামে তাঁর রবীন্দ্রসংগীত-বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলনটি বেরোয়। এটিকেই আমরা রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ বলে বিবেচনা করি। বর্তমান সংকলনে এই বইটির নির্বাচিত অংশ গ্রহণ করা হয়েছে। শান্তিদেবের রচিত অপর উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রসংগীতালোচনা গ্রন্থ ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচিত্রা’-রও নির্বাচিত অংশ এখানে সংকলিত হয়েছে। সবে মিলে এই খ-টি শান্তিদেব ঘোষের রবীন্দ্রসংগীত ভাবনা দিয়ে গড়া। রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে পরবর্তী খন্ডসমূহে যে সব লেখা সংকলিত হয়েছে সেগুলো পড়ার আগে শান্তিদেবের লেখাগুলো পড়ে নেওয়া জরুরি। কেননা এসবের মাধ্যমে তিনি রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে চিন্তামূলক রচনা পাঠের প্রস্তুতি গ্রহণের পটভূমিটি তৈরি করে দিয়েছেন।  


এই খন্ডে বর্তমানকালের দুই প্রধান রবীন্দ্রসংগীত গবেষক সন্জীদা খাতুন ও সুধীর চক্রবর্তীর রচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সন্জীদা খাতুনের পরিচয় বহুমাত্রিক। রবীন্দ্রসংগীতসর্বস্ব জীবন তাঁর। তিনি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, প্রশিক্ষক, গবেষক ও একজন দক্ষ সংগঠক। দীর্ঘকাল ধরে রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সুচিন্তিত রচনাবলি প্রকাশ করে আসছেন। রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ ব্যাখ্যায় তাঁর রচিত প্রবন্ধাবলি চিন্তায় ও মননে উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে। আমরা এখানে তাঁর রচনার নির্বাচিত সংকলন উপস্থাপন করলাম। সুধীর চক্রবর্তী বাংলা গানের নানা দিক নিয়ে অক্লান্তভাবে লিখে যাচ্ছেন আজো পর্যন্ত। রবীন্দ্রসংগীত তাঁর সর্বোচ্চ আগ্রহের বিষয়। বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন ক্ষমতায়ও তিনি অতি বিশিষ্ট। আমরা বর্তমান খন্ডে রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে তাঁর রচিত কতিপয় প্রবন্ধ উপস্থাপন করলাম। আমাদের ধারণা যে, এই দুই বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত গবেষকের প্রবন্ধ-সংকলন রবীন্দ্রসংগীতের ভাবব্যঞ্জনা ও তাকে তীব্র করে তোলার জন্যে রবীন্দ্রনাথের যে অসাধারণ সুর প্রয়োগকথা, তাকে বুঝতে সাহায্য করবে।

শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ‘রবীন্দ্রসংগীত চিন্তা’, অরুণ ভট্টাচার্যের ‘রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারা’, আনিসুর রহমানের ‘অসীমের স্পন্দ’ ও করুণাময় গোস্বামীর ‘রবীন্দ্রসংগীত পরিক্রমা’র নির্বাচিত অংশ সংকলন করে এই খন্ডের পাঠ প্রস্তুত করা হয়েছে। রবীন্দ্রসংগীতচর্চা হিসেবে শৈলজারঞ্জনের স্থান সর্বাগ্রে। তিনি সারাজীবন একটি আদর্শকে অলঙ্ঘনীয় জ্ঞান করে রবীন্দ্রসংগীত শিখিয়েছেন ও সে সম্পর্কে বলেছেন। সে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ যেমনভাবে তাঁর গান গাওয়া হোক বলে চাইতেন, তেমনভাবে তাঁর গান গাওয়া। রবীন্দ্রসংগীতে মনগড়া কোনো কিছু জুড়ে দেওয়ার বা রবীন্দ্ররচিত সুর থেকে কোনো কিছু বাদ দেওয়ার অধিকার কারো নেই। এর প্রয়োজন পড়ে না। রবীন্দ্রনাথের গান একটি সম্পূর্ণ রচিত বিষয়। এর থেকে কোনো কিছু নিলে বা এখানে কোনো কিছু দিলে এর অঙ্গহানি হয়। এই মূল বক্তব্যকে অবলম্বন করে শৈলজারঞ্জন রবীন্দ্রগানের সুরপ্রয়োগ করার মর্মটি ব্যাখ্যা করেছেন। অন্য দু-দশ ধরনের রচনা থেকে রবীন্দ্রচিন্তার পার্থক্য কোথায় তা আমরা সেখান থেকে বুঝে নিতে পারি। ‘রবীন্দ্রগানের মুক্তধারা’ গ্রন্থে অরুণ ভট্টাচার্য রবীন্দ্রসংগীতের নান্দনিক বিশ্লেষণের অনেকগুলো দিক নিয়ে এসেছেন। এর আগে অমিয়রঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় সাধারণভাবে সংগীতের সৌন্দর্যদর্শনের ধারণাগুলো পাওয়া গিয়েছিল। অরুণ ভট্টাচার্যের লেখায় রবীন্দ্রসংগীতের নন্দনতাত্ত্বিকতার ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। রবীন্দ্রনাথ নিজেও সৌন্দর্যতত্ত্ব বিষয়ে অত্যন্ত অভিনিবিষ্ট ছিলেন। তিনি সৌন্দর্যের বিষয় দেখেছেন গানে, নাচে, চিত্রকলায়, কবিতায়, নাটকে, কথাসাহিত্যে। সবে মিলে সংগীতের জন্যে তিনি একটি নন্দনতত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিলেন। অরুণ ভট্টাচার্যের সংকলিত প্রবন্ধসমূহে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। আনিসুর রহমান ‘অসীমের স্পন্দ’ প্রবন্ধ সংকলনের মূল যে বক্তব্য বিষয় তাকে বলেছেন ‘রবীন্দ্র-সংগীতবোধ ও সাধনা’। তিনি একদিকে যেমন রবীন্দ্রনাথের গানের ভাবসম্পদ ব্যাখ্যা করেছেন, অন্যদিকে রবীন্দ্রসংগীত গাইবার জন্যে উপযুক্ত ক্রিয়াতর কণ্ঠ তৈরির কৌশল  সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি এখানে তুলনামূলক শিক্ষাতত্ত্বের ওপর আলোকপাত করেছেন। করুণাময় গোস্বামীর যেটুকু লেখা অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে নির্বাচিত করা হয়েছে তাতে গদ্য গানের নির্মাতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের যে বিস্ময়কর অর্জন সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। রবীন্দ্রসংগীততত্ত্ব বলতে যে বিষয়টিকে এখন আমরা বোঝাই সেটি রবীন্দ্রনাথ নিজে যেভাবে বোঝাতে চেয়েছেন তার অনুসরণই আরো বিস্তৃত করা হয়েছে। রবীন্দ্রসংগীতে গায়কী স্বাধীনতার মতো তর্কসাপেক্ষ বিষয়টিও এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সব মিলে তিন খন্ডে অর্থাৎ চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ খন্ড মিলে রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে চিন্তামূলক রচনার একটি নির্বাচিত সংকলন উপস্থাপিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করা চলে যে, এর দ্বারা সামগ্রিক অর্থে রবীন্দ্রনাথের গান বিষয়টি অনুধাবন করে ওঠা সহজ হবে।


বাংলা নাগরিক গানের বিকাশে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান বিস্ময়করভাবে বিপুল। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালের মার্চে নজরুল তাঁর সেনাজীবনের কর্মস্থল করাচি থেকে কলকাতা ফিরে আসেন। শৈশব থেকেই গীতরচনায়, সুরযোজনায় ও উপস্থাপনে তিনি যশস্বী হয়েছিলেন। তবে সংগীত-রচয়িতা হিসেবে নজরুলের যথার্থ জীবনের সূচনা ১৯২০ সালের মধ্যভাগ থেকে। ১৯২৬ সালের শেষদিক পর্যন্ত নজরুলের জীবন কর্মবৈপুল্যে ভরপুর। তবে গজল রচনা করে সংগীতরচয়িতা হিসেবে যখন তিনি বিপুল গতিতে গীতরচনায় সমাজে আদৃত হলেন তখন থেকেই সংগীতকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অর্থকষ্ট দূর করাও এই অভিপ্রায়ের প্রেরণা ছিল। সাহিত্যচর্চা করে কোনোক্রমেই সংসার চালানো যাচ্ছিল না। বরং দেখা গেল যে, গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডে গান দিলে যে রয়্যালটি পাওয়া যায় তাতে রোজগার বেশি হয়। সচ্ছল জীবনযাপনের তাগিদেই নজরুল ১৯২৮ সালের প্রথমার্ধে গ্রামোফোন কোম্পানি ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েসে’ যোগ দেন। বস্তুত তখন থেকেই গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও প্রশিক্ষক হিসেবে শুরু হয় তাঁর বিস্ময়করভাবে বিপুল সাফল্যেভরা জীবন। গজল রচনার ধারাবাহিকতায় গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগ দিতে অনুরুদ্ধ হয়েছিলেন। যোগ দেওয়া মাত্র শুধু গজল নয়, যত রকম গান রচনা সম্ভব তত রকম গান রচনায় তিনি মনোযোগ দিলেন এবং বৈচিত্র্যে, বৈপুল্যে ও সাফল্যে কথাকেন্দ্রিক সংগীতরচনা-কর্মকান্ডের মধ্যমণি হয়ে উঠলেন। সবাক চলচ্চিত্রের সূচনায় নজরুল চলচ্চিত্র-সংগীতের সঙ্গে যুক্ত হলেন, বাংলা মঞ্চসংগীতের হাল ধরলেন এবং এইচ.এম.ভি. ছাড়াও অন্য সব দেশি রেকর্ড কোম্পানির অপরিহার্য গায়ক রচয়িতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সক্রিয় জীবনের শেষের দিকে কলকাতা বেতারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেখান থেকেও নিরীক্ষামূলক রাগসংগীত রচনায় নজরুল এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। ১৯২৬ থেকে ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি কাল পর্যন্ত সময়ে প্রধানত নজরুল প্রায় তিন হাজার গান রচনা করেন। প্রচলিত সংগীতপ্রবাহে নবপ্রাণ সঞ্চার করে এবং নব নব ধারা যোজনা করে বাংলাগানকে তিনি অশেষ সমৃদ্ধি দান করেছিলেন।  নজরুলের গান নিয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনা হয়েছে কম। এই খন্ডে করুণাময় গোস্বামী ও আবদুশ শাকুরের নজরুল সংগীতালোচনার নির্বাচিত অংশ অন্তর্ভুক্ত করা হল। নজরুলসংগীতের স্বরূপ অনুধাবনে এই খন্ডটি অপরিহার্য হয়ে উঠবে বলে আশা করি।  

এই খন্ডে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন ও কাজী নজরুল ইসলামের সংগীত রচনা ও সাংগীতিক অবদান সম্পর্কে রচিত নির্বাচিত রচনা সংকলিত হল। পঞ্চপ্রধান বাঙালি সংগীত-রচয়িতার এই চার প্রধান সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে কম, কারো কারো, যেমন রজনীকান্ত সম্পর্কে একেবারেই কম। অতুলপ্রসাদ সম্পর্কেও কয়েকটি প্রবন্ধ লেখা হয়েছে মাত্র। 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পাশ্চাত্য সংগীতরীতির সঙ্গে বাংলা নাগরিক সংগীতরীতির নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করেন। এ বিষয়টি যে কতটা দূর-প্রসারী হয়ে ওঠে তা সমকালে বোঝা যায়নি। শুধু হাসির গানে সুরের উত্থানপতন বাহুল্যকে অতিমাত্রায় তারিফ করেছেন আলোচকগণ। দেশাত্মবোধক গানে পাশ্চাত্য সংগীত ঢঙ প্রয়োগের বিষয়টিও তাঁরা প্রশংসার সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু বাংলা নাগরিকসংগীতে সুরের চলাচলে সামগ্রিক অর্থে তিনি যে একটা নতুন পথের সন্ধান দিয়ে গেলেন সেই বিষয়টির আর উল্লেখ করা হল না। রজনীকান্ত খেয়াল বা টপ্পা অঙ্গে গান রচনায় একটি অনবদ্য ব্যক্তিগত পথ অনুসরণ করেছিলেন। এর স্বরূপ নিয়েও তেমন একটা উচ্চবাচ্য হয়নি। অতুলপ্রসাদের পথপ্রদর্শক পর্যায়ের অনেক কাজ আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে। নজরুলের গান নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছে, তবে মানোত্তীর্ণ আলোচনার পরিমাণ নিতান্তই কম। এই খন্ডে নজরুল সম্পর্কে লেখাটি রাখা হয়েছে শুধু পূর্ববর্তী খন্ডের ধারাবাহিকতায়। রাগসংগীত রচয়িতা হিসেবে নজরুলের অবদানকে উচ্চমূল্য দিতে দেখা যায়। সংকলিত আলোচনায় দেখাবার চেষ্টা করা হয়েছে, নজরুলের যথার্থ অবদানের ক্ষেত্র হিন্দুস্তানি রীতিপ্রভাবিত সুরপ্রধান গান নয়, কাব্যে ও সংগীতে মিলনের আদর্শে রচিত গানেই তাঁর যাথার্থ্য। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান সম্পর্কে সুধীর চক্রবর্তীর যে লেখাটি সংকলিত করা হয়েছে, তা এই বিষয়ে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি উপস্থাপনা। অতুলপ্রসাদ সেন সম্পর্কে দিলীপকুমার রায়, রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ কয়েকজনের লেখা সংকলিত হল। রজনীকান্ত সেন সম্পর্কে চিন্তামূলক লেখা নিতান্তই কম। এখানে সে বিষয়ক দুটি লেখা অন্তর্ভুক্ত করা হল। আশা করি সপ্তম ও অষ্টম খন্ড মিলিয়ে পড়লে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন ও কাজী নজরুল ইসলামের সংগীতের অবদানের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।  


নবম খন্ডে বাংলা গানের সূচনাকালীন রূপ চর্যাগীতি ও নাথগীতি এবং অব্যবহিত পরবর্তী গীতগোবিন্দের গান নিয়ে আলোচনা থাকছে। সেইসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলগান, শাক্তপদাবলী, টপ্পা, ধ্রুপদ, ব্রহ্মসংগীত ও দেশাত্মবোধক গান সম্পর্কে আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। চর্যাগীতি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও মঙ্গলগানের সাংগীতিক রূপ সম্পর্কে এখানে যে-চিন্তার সূত্রটি ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে তা গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে এসব বিষয় নিয়ে সাহিত্য ও দর্শনের পটভূমিতে আলোচনা করা হয়েছে। চর্যা সম্পর্কে ভাবা হয়েছে যে, এই গানের নাম চর্যা এ কারণে যে, এই গানের ভেতর দিয়ে নির্বাণ লাভের উপায় হিসেবে বৌদ্ধযোগীদের আচরণীয়-অনাচরণীয় বিষয়সমূহকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। চর্যা যে এক প্রকার গানের নাম, মধ্যযুগে সারা ভারতে যে চর্যা নামে এক ধরনের প্রবন্ধ সংগীতের প্রচলন ছিল এবং সেই শ্রেণির গানের দৃষ্টান্তের অনুসরণে রচিত বলে সূচনাকালীন বাংলা গানের নাম চর্যা, এ ব্যাখ্যাটি সাংগীতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি মঙ্গলগান নামটি যে দৈবশক্তির গুণকীর্তনে মঙ্গল এমন বোধ থেকে আসেনি, মঙ্গল বা মঙ্গলাচার প্রবন্ধ সংগীতের আদর্শে রচিত বলে গানের নাম মঙ্গলগান হয়েছে, তেমন অনুসন্ধানী বক্তব্য প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ। 

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় স্বরলিপির সাহায্যে সংগীত লেখনের প্রচলন হয়। ব্রাহ্ম সমাজ এ ব্যাপারে উৎসাহজনক কার্যসূচি গ্রহণ করে। ফলে তখন থেকে লিখিত আকারে রক্ষিত বাংলা গানের একটি প্রামাণ্যরূপ আমরা পাই। পদাবলী কীর্তন বা টপ্পার যে ঢঙ একাল পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে বা রামপ্রসাদী সুরের যে ঢঙটিকে আমরা পাই, তা সবই পরম্পরারহিত। কিন্তু প্রাচীন সংগীতের কোনো পরম্পরারহিত রূপও আমরা পাই না। যা কিছু ধারণা আমাদের তৈরি করে নিতে হয় সবই আলোচনা থেকে। এ মর্মে প্রাচীন বাংলা গানের আলোচনা একটি অতিরিক্ত গুরুত্ব বহন করে। পদাবলী কীর্তন বিষয়ে আলোচনা এই খন্ডে অন্তর্ভুক্ত করা গেল না। পরবর্তী খন্ডে তা সন্নিবেশিত হবে। খন্ড ক্রমিক আকার আয়ত্তে রাখার জন্যেই এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হল।  

এই খন্ডে পদাবলীকীর্তন ও রাগপ্রধান বাংলা গান সম্পর্কে আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হল। পরিশিষ্ট অংশে থাকল ‘স্মৃতির অতলে’। পদাবলীকীর্তন সম্পর্কে বেশ কয়েকটি বই লেখা হয়েছে। তবে আলোচনা অধিকাংশক্ষেত্রেই বিবরণমূলক। ভারতবর্ষের সংগীতালোচনার এটি একটি দুর্বল দিক। সংগীত বিষয়ে শত সহস্র বই লেখা হয়েছে। সবারই বিবেচ্যবিষয় হচ্ছে কোত্থেকে কী এলো, কী করলে কী হয় এমন ধরনের সমস্যা। সংগীত রচনার অন্তর্গত চিন্তাস্রোতের স্বরূপ কী, সে বিষয়ে আলোচনার পরিমাণ কম। সেজন্যে চিন্তামূলক লেখা সংকলনের সময়ও আমাদের বিবরণমূলক লেখাকে প্রশ্রয় দিতে হয়। বিবরণের মূল্য যে কম নয়, সে কথা সকলেই স্বীকার করতেন। সারা পৃথিবীতে কথাবিদ্যার সকল শাখার ওপরই প্রাথমিক দিককার আলোচনা বিবরণমূলক। তবে পরবর্তীতে, ইউরোপে যেমন চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে বিবরণদানের পাশাপাশি সৌন্দর্যসন্ধানের চেষ্টা হয়েছে প্রগাঢ়ভাবে, ভারতবর্ষে সংগীতালোচনায় বিবরণ-প্রাধান্য বজায় থেকেছে। পদাবলীকীর্তন সম্পর্কে বাংলায় প্রথম সৌন্দর্যসন্ধানী আলোচনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দিলীপকুমার রায়। তাঁদের দৃষ্টান্তে পরবর্তীতে এ ব্যাপারে কিঞ্চিৎ চিন্তামূলক আলোচনা করা হয়েছে। পদাবলীকীর্তন সম্পর্কে অনেক আলোচনা সংকলিত করা সম্ভব নয় বলে আমরা স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের পদাবলীকীর্তন-বিষয়ক একটি দীর্ঘ আলোচনা এই খন্ডে অন্তর্ভুক্ত করলাম। এ আলোচনা বিবরণদান ও চিন্তনপ্রয়াসের এক চমৎকার সমন্বয়। বাংলা রাগপ্রধান গান সম্পর্কে আলোচনা এই খন্ডেই অন্তর্ভুক্ত করা হল। কালের বিবেচনায় রাগপ্রধান বহু পরবর্তী। ১৯৩০ সালের দিক থেকে কলকাতায় গ্রামোফোন কোম্পানি ও সবাকচিত্রের পরিমণ্ডলে এর প্রকাশ।খন্ডক্রমিক পৃষ্ঠা সংখ্যায় এক ধরনের সমতাবিধানের জন্যে এরকম আগে-পরে করতে হয়। অমিয়নাথ সান্যালের ‘স্মৃতির অতলে’ বইটি এই খন্ডের পরিশিষ্টে গ্রন্থিত হলো। বাংলা ভাষায় সংগীত বিষয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ স্মৃতিচারণ গ্রন্থ এটি। সেই সঙ্গে সংগীতালোচনাও। ‘স্মৃতির অতলে’ নিজেই নিজের তুলনা। সংগীতালোচনায় চিন্তা ও কবিত্ব যে কী বিস্ময়করভাবে সমন্বিত হতে পারে, অমিয়নাথ তার এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। বাঙালি সংগীতপ্রেমীদের কাছে এই স্মৃতিচারণ সহজলভ্য করার পরিকল্পনা থেকে সেটিকে বর্তমান খন্ডে জড়িত করা হল। 


 এই খন্ডে বাংলা নাটকের গান সম্পর্কে জরিপ ও বিশ্লেষণমূলক একটি দীর্ঘ আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর সঙ্গে থাকছে বাংলা আধুনিক গান সম্পর্কে রচিত একটি প্রবন্ধ। ড. প্রভাতকুমার গোস্বামী বাংলা নাট্যসংগীত গবেষক হিসেবে যশস্বী হয়েছিলেন। তিনি স্বয়ং সংগীতজ্ঞ এবং সংগীত ও নাট্যরচয়িতা ছিলেন। সেজন্যে তাঁর পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলা নাট্যসংগীতের স্বরূপ ব্যাখ্যানেও তাঁর চিন্তাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়। এই বিবেচনায় আমরা প্রভাতকুমার গোস্বামীর আলোচনাকেই নির্বাচিত আকারে মুদ্রিত করলাম। আধুনিক বাংলা গান সম্পর্কে চিন্তামূলক লেখার জন্যে সুধীর চক্রবর্তী সুবিদিত। তিনি সংগীতচিন্তায় একেবারে মর্মে আলোকসম্পাত করতে জানেন। তাঁর এই নাতিবিস্তৃত লেখাটিও আধুনিক বাংলা সংগীতান্দোলনের স্বরূপটিকে উদ্ভাসিত করে তোলে। দুটি লেখাই আগ্রহী পাঠকদের উপকৃত করবে। 

এই খন্ডে বাংলা গানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। করুণাময় গোস্বামীর দু’টি লেখা বাদে সবগুলো লেখাই সুধীর চক্রবর্তীর গ্রন্থ থেকে নির্বাচিত করা হয়েছে। করুণাময় গোস্বামীর একটি লেখা ‘নাগরিক ধারার বাংলা গান’ সম্পর্কে। এতদিন পর্যন্ত বাংলা গানকে দু’টি প্রবাহে বিভক্ত করা হত। একটি লোকগান বা লোকসংগীত, অপর প্রবাহটিকে একত্রযোগে শিরোনামে অভিহিত করা হত না। পৃথক পৃথকভাবে যেমন টপ্পা, ‘ব্রহ্মসংগীত, দেশাত্মবোধক গান’ এমন সব শিরোনামে উল্লেখ করা হত বা এখনো হয়। তবে চর্যাগীতি থেকে আধুনিক বা পপ গান পর্যন্ত যে ধারা তাকে একত্রে নাগরিক গান বা নাগরিক ধারার বাংলা গান হিসেবে উল্লেখ করা হল। পরবর্তী প্রবন্ধটি হচ্ছে গেল পঞ্চাশ বছরের বাংলা নাগরিক গানের গতিপ্রকৃতি নিয়ে। এছাড়া এই খন্ডের অধিকাংশ নির্বাচিত রচনাই সুধীর চক্রবর্তী লিখিত। বর্তমান কালের বাংলা গান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্লেষণমূলক লেখা এই সব। বাংলা গান সম্পর্কে লিখতে গেলে সুধীর চক্রবর্তী সর্বদাই চিন্তার কোনো-না-কোনো নতুন দিগন্তে নিয়ে যান। এই সব লেখায় তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। গণসংগীতসহ বাংলা গানের নানা দিক নিয়ে আলোচনা সংবলিত এই খন্ড পাঠকদের উপকৃত করবে বলে বিশ্বাস রাখি। 


এই খন্ডটি বাংলা লোকসংগীত বিষয়ে চিন্তামূলক লেখার সংকলন। বাংলা লোকসংগীত নিয়ে এ যাবৎ যা কাজ হয়েছে তার অধিকাংশই সংগ্রহ ও সংকলনমূলক। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংগৃহীত ও সংকলিত গান সম্পর্কে বিবরণ। এ বিষয়ে কিছু চিন্তামূলক কাজ হয়েছে সমাজতত্ত্বের পটভূমিতে। এর সঙ্গে সাংগীতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। সংগীতচিন্তার পটভূমিতে লোকসংগীত সম্পর্কে কাজের পরিমাণ নিতান্তই অল্প। কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্রটি অতীব প্রসারিত হতে পারতো। কেননা বাংলা লোকসংগীতে রূপবৈচিত্র্য বিপুল। এই বৈচিত্র্যের পেছনে আঞ্চলিকতা কাজ করেছে। কিন্তু বৈচিত্র্যের যে সাংগীতিকতা তার কোনো সৌন্দর্য-সংগত ব্যাখ্যা নেই। সিলেট অঞ্চলের বাউলের যে সব রূপ তার সঙ্গে কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাউলের গেয়রূপের পার্থক্য আছে। সিলেট অঞ্চলে বাউল রূপ গড়ে উঠেছে প্রধানত নিম্নাঞ্চলীয় সিলেটে। সেখানকার গায়নভঙ্গির ওপর জলমগ্নতা, প্লাবন, তরঙ্গভঙ্গ যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। কিন্তু সেই প্রভাব স্বর প্রয়োগ ও স্বরোচ্চারণের মধ্যে কীভাবে রূপ পেল তার ব্যাখ্যা আমরা পাই না। রাগসংগীত ও লোকসংগীতের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। ধারণা করা হয় যে, ভাটিয়ালি বলে যে এক ধরনের সুরসংগঠনরীতিকে আমরা শনাক্ত করি, তার পেছনে রাগ-ভাটিয়ালি বা ভাটিয়ালির সম্পর্ক আছে। রাগস্তরে ভাটিয়ালি আগে, না লোকস্তরে ভাটিয়ালি আগে তা আমাদের জানা নেই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ভাটিয়ালি-রাগের উল্লেখ পাই। সেখানে এই রাগে রচিত গান আছে। অনেকে মনে করেন রাগরূপ ভাটিয়ালি আগে, লৌকিক রূপে ভাটিয়ালি পরে। কিন্তু এদের রূপপরিবর্তনের ঘটনা সম্পর্কে কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি। বাউলের বেলায়ও একই ঘটনা। বাউলতত্ত্ব নিয়ে শত শত প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। কিন্তু বাউলের সাংগীতিকতা নিয়ে নির্ভরযোগ্য কাজ নেই। 

লোকসংগীত সম্পর্কে চিন্তামূলক রচনা সংকলন প্রস্তুত করতে গিয়ে আমাদের অত্যন্ত কষ্ট হয়েছে। বিবরণমূলক লেখাকে বাদ দিতে চেষ্টা করেও পারা যায়নি। চিন্তামূলক লেখার পাশাপাশি আমরা বিবরণমূলক লেখাও সংকলিত করেছি। আমাদের ধারণা যে, উভয় প্রচেষ্টার সহাবস্থানে হয়তো বাংলা লোকসংগীতের মর্মসন্ধানের চেষ্টা কিছু-না-কিছু হলেও সফল হয়ে উঠবে। লোকসংগীতের প্রতি অপার প্রেমের জন্যে খ্যাত পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের লেখা আছে এই সংকলনে; গায়ক ও সংগীতজ্ঞ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের লেখাও এখানে রয়েছে। সংগীততত্ত্ববিদ অধ্যাপক সুকুমার রায়ের লেখাও এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সবে মিলে বাংলা লোকসংগীতচিন্তার ব্যাপারটা এক রকম দাঁড়িয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের তুলনামূলক সংগীতালোচনার পদ্ধতিটি আমাদের লোকসংগীত গবেষকদের অত্যন্ত কাজে লাগবে বলে মনে করি।