Arthoniti Chinta
Arthoniti Chinta

সমাজচিন্তার খন্ড সমূহ

ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮০-১৯৬১) বিশ্বখ্যাত হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ। কলকাতার অ্যাটর্নি বিশ্বনাথ দত্তের জ্যেষ্ঠপুত্র নরেন্দ্রনাথ দত্তই অধ্যাত্মবাদী সন্ন্যাসী হয়ে নাম ধারণ করেন স্বামী বিবেকানন্দ। ভূপেন্দ্রনাথ অগ্রজের প্রতি একান্ত শ্রদ্ধাশীল হয়েও নিজে অধ্যাত্মবাদী বা সন্ন্যাসী হওয়ার বদলে হন বস্তুবাদী ও সমাজবিপ্লবী। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী তথা মার্কসবাদী দৃষ্টিতে ভারতের প্রাচীন ইতিহাস রচনায় বাঙালিদের মধ্যে তিনিই পথিকৃৎ। 

বিশিষ্ট মার্কসবাদী  লেখক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য মনে করেন-- 

‘ঐতিহাসিক হিসেবে ভূপেন্দ্রনাথকে এখনও তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি। অথচ তিনি শুধু পথিকৃৎ নন, সফল ব্যাখ্যাকার। তথ্য সংগ্রহ করেই তাঁর কাজ শেষ হয় না, বিষয়গতভাবে তার বিশ্লেষণ করেন একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। ‘মডেল’ হিসেবে একাজ গ্রাহ্য হওয়া উচিত।’

অতুল সুরের ‘বাঙলার সামাজিক ইতিহাস’ ও রেবতী বর্মণের ‘সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ’ গ্রন্থদুটো পাশাপাশি রেখে পাঠ করলে সমাজ-বিকাশের সূত্রটি অতি অনায়াসে পাঠকের চৈতন্যগোচর হবে। গ্রন্থদুটো, এক অর্থে, পরস্পরের পরিপূরক। কার্লমার্কস সমাজ-বিকাশের যে-সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন, সেই সূত্রের অনুসরণেই রেবতী বর্মণ সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের প্রাঞ্জল বর্ণনা দিয়েছেন। আদিম সমাজের ভাঙনের মধ্য দিয়ে গোলামি ব্যবস্থা বা দাসতন্ত্রের উদ্ভব, দাসতন্ত্র থেকে সামন্ততন্ত্র বা ভূমিদাস প্রথা, এরপর পুঁজিতন্ত্র এবং পুঁজিতন্ত্রের পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পর্যন্ত বিশ্বপরিসরে মানবসমাজের ক্রমবিকাশ ও সভ্যতার ক্রমরূপান্তরই রেবতী বর্মণের গ্রন্থের বিষয়বস্তু। অন্যদিকে অতুল সুর আলোচনা করেছেন ‘বাঙলা’ নামে পরিচিত ভূখ-টি নিয়ে, বাঙলার অধিবাসীদের আনুপূর্বিক পরিচয়ই বিধৃত অতুল সুরের বইটিতে। 

রেবতী বর্মণ ছিলেন সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজবিপ্লবী, আর অতুল সুর মূলত নৃবিজ্ঞানী। নৃবিজ্ঞানীর দৃষ্টি দিয়েই তিনি ‘বাঙলার সামাজিক ইতিহাস’ রচনা করেছেন। তবে শুধু নৃবিজ্ঞান নয়, ইতিহাস রচনায় তিনি সামাজিক বিজ্ঞানের সকল ভা-ার থেকেই তত্ত্ব ও তথ্য আহরণ করেছেন। শেষ করেছেন ‘রূপান্তরের পথে নাগরিক সমাজ’-এর সুনিপুণ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে। মাঝখানের তেইশটি অধ্যায়ে ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ থেকে শুরু করে তার রাষ্ট্রীয় ইতিহাস, অর্থনৈতিক জীবন, ধর্মসাধনা, জীবনযাত্রা প্রণালী ও সাহিত্যসাধনাসহ সকল কিছুর সংক্ষিপ্ত অথচ প্রাঞ্জল বিবরণ তুলে ধরেছেন। 


বিনয় ঘোষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও নৃতত্ত্বে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। এরপর সাংবাদিক রূপে তাঁর কর্মজীবনের শুরু। সুভাষ চন্দ্র বসুর ‘সাপ্তাহিক ফরোয়ার্ড’ থেকে শুরু করে ‘সাপ্তাহিক অরণি’, ‘দৈনিক বসুমতি’, ‘যুগান্তর’ এবং এ-রকম আরও অনেক সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে তিনি যুক্ত থেকেছেন। সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মকা-ও তিনি চালিয়ে গেছেন। পরে সাংবাদিকতা ও প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংশ্রব ছেড়ে হয়ে ওঠেন সার্বক্ষণিক গবেষক ও লেখক।

আসলে সমাজবিজ্ঞানীই হচ্ছে বিনয় ঘোষের মূল পরিচয়। বিশেষ করে উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ সম্পর্কে তাঁর গবেষণা ও সমীক্ষা অসাধারণ ও অতুলনীয়।তিনি দেখেছিলেন যে ধ্বংসের পাশাপাশি ইংরেজরা এদেশে সৃজনের নকিব না হয়েও পারে নি। তবে তেমনটি তারা স্বেচ্ছায় বা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাদের মঙ্গল সাধনের শুভ উদ্দেশ্য নিয়ে করে নি, ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে করতে বাধ্য হয়েই করেছে। মার্কসের ভাষায় ইংরেজরা ‘ইতিহাসের অচেতন যন্ত্র রূপে’ ভারতবর্ষে এমন একটি বিপ্লব সাধন করে ফেলেছে যেটি ‘এশিয়ায় এ যাবৎ-শ্রুত একমাত্র বিপ্লব।’ 

সেই ‘বিপ্লব’টির সূচনা ঘটেছিল তৎকালীন ভারতবর্ষের বাংলা অঞ্চলে। উনিশ শতকে বাংলার সেই সামাজিক রূপান্তরকেই বিনয় ঘোষ পর্যবেক্ষণ করেছেন মার্কসীয় দৃষ্টিতে। তিনি এখানকার ‘গ্রাম সমাজের পরিবর্তনের গতি’টি যেমন লক্ষ করেছেন, তেমনই সুনিপুণভাবে পর্যালোচনা করেছেন ‘নাগরিক সমাজের রূপায়ণ’, ‘বাঙালির শিল্পোদ্যম’, ‘বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী’ এবং উনিশ শতকের বাংলার ‘সামাজিক জীবনের প্রবাহ’টিকে।


উনিশ শতকের বাংলায় তথা ভারতবর্ষে রাজা রামমোহন রায়ই রেনেসাঁসের পথিকৃৎ বলে কথিত। অবশ্যি এদেশে কোনো রেনেসাঁস আদৌ সংঘটিত হয়েছিল কিনা, এ বিষয়ে বিতর্ক চলে এসেছে দীর্ঘকাল ধরে। তবু বর্তমানে সেই বিতর্কে আর আগের সেই ধার নেই। উনিশ শতকে বাংলায় রেনেসাঁসের মতো একটা ঘটনা অবশ্যই ঘটেছিল-- এ-রকম একটি বক্তব্য এখন সর্বজনগ্রাহ্য না হলেও বহুজনগ্রাহ্য। 

একজন অসাধারণ আলোকপ্রাপ্ত মানুষ রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন হিন্দু সমাজে। তখনকার দিনে হিন্দু সমাজে প্রচলিত বিধিবিধান যে নতুন যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, হিন্দুদের নানা ধর্মীয়বিধান যে তাদের চলার পথে পর্বতপ্রমাণ বাধা হয়ে আছে, এই ধর্মের যুগোপযোগী সংস্কার করে না নিলে যে ওরা কোনো রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা বা সামাজিক স্বস্তি ভোগ করতে পারবে না-- রামমোহনের মর্মে মর্মে এই বোধের সঞ্চার ঘটেছিল। সেই বোধ থেকেই তিনি হিন্দুর ধর্মশাস্ত্রের প্রতি সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন এবং এর পুনর্মূল্যায়নে নেমেছিলেন। শাস্ত্রকে মেনেই ছিল তাঁর শাস্ত্রের পুনর্মূল্যায়ন-প্রয়াস। সে প্রয়াসের ফলই রামমোহনের হাতে ‘আত্মীয় সভা’র প্রতিষ্ঠা ও ‘ব্রাহ্মসমাজ’-এর পত্তন। ব্রাহ্মসমাজই পরে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে পরিণত হয় ব্রাহ্মধর্মে।

শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিদ্বজ্জন। তাঁদের সকলের সম্মিলিত প্রয়াসেই সমাজে অনেক সদর্থক পরিবর্তন ঘটেছে, এবং এখনও ঘটে চলছে।

বিদ্যাসাগরের উত্তরসূরি মনীষীবৃন্দ আরও অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। তাঁদের কেউ কেউ ধ্রুপদী শাস্ত্রগ্রন্থের বাইরে লোকায়ত চিন্তা ও জীবনচর্যার দিকেও মুখ ফিরিয়েছেন, এবং ধ্রুপদী শাস্ত্রের ব্যাখ্যা-ভাষ্য নির্মাণেও প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। কেউ কেউ বিদ্যাসাগরের মতো রেডিক্যাল ভাবনার ধারক না-হয়েও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ধর্মশাস্ত্রের বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন, সামাজিক বিবর্তনের ধারায় কীভাবে শাস্ত্র-বিধানেও পরিবর্তন ঘটেছে উদারতা ও মুক্তবুদ্ধির সঙ্গে তার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছেন। এ-রকমই একজন উদারচিত্ত ও অনুসন্ধান-বিশারদ মনীষী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১)।

হরপ্রসাদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন ‘চর্যাপদ’-এর আবিষ্কারক।’ 

‘জাতীয় আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ’, ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’ প্রভৃতি গ্রন্থে তাঁর ইতিহাস-বীক্ষা ও মননশীলতার পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়েছে।

প্রফুল্লকুমার সরকারের ‘ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের প্রথিতযশা অধ্যাপক রংগলাল সেন ‘বাংলাদেশের সামাজিক স্তরবিন্যাস’ সম্পর্কে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। 



একালে যে বিদ্যাশৃঙ্খলাকে আমরা ‘সমাজবিজ্ঞান’ বলে জানি, শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯) তার চর্চা করেছেন-- এমন কথা আমরা অবশ্যই বলতে পারি না। তবে তাঁর রচনা যে পরবর্তীকালে বাঙালি সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য (বিশেষ করে উনিশ শতকের বাংলার সমাজ রূপান্তরের বিষয় নিয়ে যাঁরা চর্চা করেছেন) অনেক উপাদানের জোগান দিয়েছে, সে কথা স্বীকার করতেই হবে। বিশেষ করে তাঁর ‘আত্মচরিত’ ও ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ বই দুটোর শরণ না নিয়ে উনিশ শতকের বাংলা সমাজ-সমীক্ষণ একেবারেই অসম্ভব।

উনিশ শতকের সত্তরের দশকেই শিবনাথ এদেশে ইউটোপীয় ধাঁচের সাম্যভাবনারও সূত্রপাত ঘটান। ১৮৭৪ সালে তাঁরই মতো প্রাগ্রসর চিন্তার অধিকারী কতিপয় ব্রাহ্মকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ‘সমদর্শী’ (মরর্ দণ ফধঠণরটফ)  নামে একটি দ্বিভাষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন, এবং সেই পত্রিকাটিকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে ‘সমদর্শী গোষ্ঠী’। এই গোষ্ঠীটি তাদের প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বায়ত্তশাসনের আদর্শ প্রচার করে এবং জাতিভেদ-বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রতি ঘৃণারও প্রকাশ ঘটায়-- 

বাংলা ভাষাভাষী পুরো জনগোষ্ঠীকে যদি একটি অখ- সমাজ ধরে নেয়া হয় তাহলেও আমরা লক্ষ করব যে, এরই মধ্যে রয়েছে আরও অনেক ছোট ছোট সমাজ। ছোট এই সমাজগুলো সুতরাং বৃহত্তর অখ- সমাজের মধ্যে নানা অনুষঙ্গ হাজির করে চলেছে। এইসব অনুষঙ্গ সমাজের মধ্যেকার ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে সৃষ্টি করে বিচিত্র জটিলতা। এর থেকে মুক্তির জন্য সমাজের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত চেতনাগত বদল ঘটাবার প্রয়োজন পড়ে। বদলের প্রকৃতি ও কারণগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে মানুষ। নতুন এইসব চিন্তা পরিশ্রুত হয়ে এগিয়ে চলে পারস্পরিক বাদানুবাদের মধ্য দিয়ে। 

বিশ শতকের বাঙালি সমাজচিন্তার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে বাঙালির আত্মপরিচয় সন্ধান। সমাজচিন্তার গতিপ্রকৃতি অনুধাবনের সুবিধার্থে এই খন্ডে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগবিষয়ক গবেষক আহমদ শরীফ-এর ‘বাঙলার সমাজে, সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে মুসলিম অবদান’ এবং মোহাম্মদ আকরম খাঁ-এর ‘মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’ রচনা দুটি অন্তর্ভুক্ত হল। বাংলার মুসলমান সমাজের গঠনভিত্তি উন্মোচিত হয়েছে এই রচনাদুটিতে। উপর্যুক্ত প্রবন্ধে আহমদ শরীফের মতে, ‘আরব-তুর্কি-ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণের সংস্পর্শে, অভিঘাতে যে ভাবতরঙ্গ উত্থিত হয়, মননে চিন্তনে যে তত্ত্বের ও তথ্যের প্রভাব পড়ে, জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে আত্মোন্নয়নের, আত্মবিস্তারের যে অশেষ সম্ভাবনার ও আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ ঘটে অবজ্ঞেয় তুচ্ছ বৃত্তি-নিবদ্ধ প্রাজন্মক্রমিক দারিদ্র্যক্লিষ্ট আবর্তিত জীবনে, তাতে দ্রোহী সন্তদের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণ্য সমাজ ছেড়ে এরা ভক্তিবাদী স্বাধীন স্বতন্ত্র সমাজ বা স্থানিক সম্প্রদায় গঠন করে মুক্তির স্বাদ ও স্বস্তির সুখ পেতে থাকে। মুসলমান সমাজ পূর্ববর্তী সমাজকাঠামোকে পরিবর্তনের  উদ্যোগে এগিয়ে আসে সামাজিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণে খানিকটা দেরি করে। পাশ্চাত্যে বাংলাদেশের পাটের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে পাটের ব্যবসার মাধ্যমে উদ্বৃত্ত পুঁজির প্রসার ঘটতে থাকে। এরই প্রভাবে পূর্ববঙ্গে বাংলাদেশের মুসলমান সমাজে গড়ে উঠতে শুরু করে মধ্যবিত্ত সমাজ। 

মধ্যবিত্ত সমাজ এখনও ভাসমান, অপরিণত ও শৌখিন বলে মানবজীবনের জটিলতা, গহন-গভীরতা, নানা অন্ধিসন্ধি বোঝার অভিজ্ঞতার তোয়াক্কা না করে এগিয়ে চলেছে। মধ্যবিত্ত সমাজের জীবনবোধের গভীরতা না বাড়লে বাংলাদেশের যথার্থ অগ্রগতি সম্ভব হবে না। 


উনিশ শতকে কলকাতা শহরে যেমন ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠীর প্রয়োজনে গৃহীত নানা পদক্ষেপের ফলে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল তেমনি গড়ে উঠেছিল ঢাকা শহরে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে পূর্ববাংলার উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। যারা উচ্চশিক্ষার আগ্রহী হয়েছিল তাদের মধ্যে সূচিত হয়েছিল মানবিকতার জাগরণ। বাংলার মুসলমান সমাজে যুক্তি, বুদ্ধি ও বিচারশীলতা ছিল খুব কম। কিন্তু এই সময় মুসলমানদের মধ্যেও এই চেতনার প্রসার ঘটতে শুরু করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক যে শিক্ষিত মুসলমান বাঙালি পরিমণ্ডল গড়ে উঠছিল তাদের মধ্যে মানবিকতা, যুক্তিশীলতা, বুদ্ধি ও বিচারশীলতা প্রধান হয়ে উঠেছিল। বলশেভিক বিপ্লবের প্রভাবও বাংলার মুসলমানদের মধ্যে দেখা গিয়েছিল। ‘সাম্যবাদী’ নামে পত্রিকায় দেখা গিয়েছিল অর্থনৈতিক অসাম্যের বিরুদ্ধে সাম্যচেতনার ইস্ফূরণ। বাংলার মুসলমানদের ভাবুকতার প্রতিফলনই ছিল সমাজ-চিন্তার মূলে। বর্তমান খন্ডে প্রধানত বিশ শতকে প্রথমভাগের সময়-পটভূমিতে রচিত কিছু প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। 

বিশের দশকেই ঢাকায় ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের তৎপতার উন্মেষ দেখা যায় । সাম্প্রদায়িকতারও উদ্ভব দেখেছেন সে-সময়কার ঢাকায়। তিনি আরো মনে করেন, ‘খেলাফত আন্দোলন বিফল হবার পর থেকে দুটো সম্প্রদায় দুদিকে চলতে থাকে এবং তাদের মধ্যে সংযোগ ক্রমাগতই কমতে থাকে। তাই দুই সমাজের উপরের স্তরে এটা আরম্ভ হয়-- কারণ হয়তো মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা। সমাজের নিচের স্তরে এ-বিষ ছড়িয়েছে অনেক পরে।’ 

শিল্প ও বাণিজ্য-নির্ভরতার দিক থেকে মুসলমান মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি ছিল খুবই কম। বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যাঁরা প্রধান ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের অধিকাংশই এসেছেন কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে। 

বিশ শতকে রুশ বিপ্লবের প্রভাব বাংলার মুসলমান সমাজেও বেশ গভীর হয়ে উঠেছিল। সে-সময় বাংলার মুসলমান সমাজের বড় একটা অংশের মধ্যে জেগে উঠেছিল চিন্তাশীলতার জাগরণ। ইসলামের ‘সাম্যবাদী’ চেতনাও জেগে উঠেছিল রুশ বিপ্লবের প্রভাবেই। তারই পরিচয় পাওয়া যায় ‘সাম্যবাদী’২ পত্রিকায় প্রকাশিত অধ্যাপক মৌলবী মোহাম্মদ সানাউল্লা এম. এ.-এর লেখা থেকে। 

বাঙালির মানবচেতনা ধর্মের-- সে ধর্ম হিন্দু, বৈদ্ধ বা ইসলাম, যে ধর্মই হোক না কেন-- তার সনাতন আচার-বিচারের চেয়ে তার আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ ও অন্তর্নিহিত মর্মবাণী বেশি আকৃষ্ট করেছে এবং সমগ্র বাংলাভাষাভাষী মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।’ 


বাংলার সমাজে ইংরেজ শাসনের প্রতিক্রিয়ায় দু’টি প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। একদল চেয়েছিলেন পাশ্চাত্যের অনুসরণ আর অন্য দলের অভিপ্রায় ছিল স্বাজাত্য ও স্বজাতীয় স্বাতন্ত্র্যকে আরো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা। ‘রক্ষণশীলতা ও সংস্কারবাদ’৮ প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন, পাশ্চাত্য-অনুসারীগণ সমাজে বড় রকমের সংস্কার করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যার প্রধান নেতৃত্বে ছিলেন রামমোহন রায় এবং ডিরোজিও। আর স্বাজাত্যপন্থীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ছিলেন রাধাকান্ত দেব। এই দুই পক্ষেরই সবলতা-দুর্বলতা সম্বন্ধে এই প্রবন্ধে আলোচনা করে লেখক দেখিয়েছেন যে এই দুইয়ের টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে বাংলার সমাজ শেষ পর্যন্ত এগিয়ে চলেছে। 

আহমদ শরীফ তাঁর ‘উনিশ শতকের বাঙলার জাগরণের স্বরূপ’১২ প্রবন্ধে উনিশ শতকের বাংলার জাগরণের সকল নায়ককেই ‘গণশত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি মনে করেন ‘রেনেসাঁসের জন্য গৌরববোধ করা, সগর্বে রেনেসাঁসের মহিমা কীর্তন করা, রেনেসাঁস ওয়ালাদের প্রশংসা করা প্রকারান্তরে গণমানবের দুর্ভোগ-দুর্দশাকে অস্বীকার করার এবং মুৎসুদ্দি-কমপ্রেডরের তারিফ করার সামিল।’ 

আহমদ ছফার মতে বাংলাদেশের উচ্চবিত্তশ্রেণির ভূমিকা বাংলাদেশের সমাজে শুধুমাত্র লুণ্ঠনের। তিনি আরো মনে করেন তাদের অবস্থা এমনকি বিদেশিদের চেয়েও খারাপ। তাদের সঙ্গে দেশের অধিকাংশ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লব। তবে প্রচলিত সংজ্ঞানুসারে নয়, প্রয়োজন নতুন স্বভাবের, নতুন ধরনের বিপ্লব।