সম্পাদক পরিচিতি
দর্শনচিন্তার খন্ড সমূহ
এ খন্ডে রামমোহন রায়ের দর্শনচিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ভাববাদী ‘একেশ্বরবাদী’ ধারণা। তিনি উপলব্ধি করেন যে, সকল ধর্মের মূলনীতি ‘এক’, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় এবং ঈশ্বরই আমাদের উপাস্য। ঈশ্বর কোনো ধর্ম-বর্ণ-গোত্র বা জাতির নয়Ñএই ঈশ্বর সার্বজনীন। তাই তাঁর মানবতাবাদ বিশ্বজনীন মানবতাবাদ। ধর্মকে দৃঢ় দার্শনিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি নিরাকার ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করে ধর্মের সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। আলোচ্য খন্ডে তাঁর বেদান্তসার, ঈশোপনিষৎসহ ১৩টি নির্বাচিত প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে।
অক্ষয়কুমার দত্তের ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’ গ্রন্থটি এ খন্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অক্ষয়কুমারের দার্শনিক ভিত্তিভূমি ছিল প্রকৃতিবাদ ও বস্তুবাদ। তিনি প্রাকৃতিক নিয়ম ও এর অনুশীলনকে মানবজীবনে অপরিহার্য বলে মনে করেন। বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনায় উদ্বুদ্ধ অক্ষয়কুমার বিজ্ঞানের নিয়মাবলিকেই স্বতঃসিদ্ধ বলে মানতেন। সমাজকে বিচার করতেন জৈব প্রত্যয়ে, মানুষ ও সমাজকে মূল্যায়ন করতেন বিজ্ঞানের যুক্তির কষ্টিপাথরে। তিনিই প্রথম মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র আবিষ্কারে সচেষ্ট হন। তাঁর বিশ্বাস বিশ্বজগৎ চলে একান্ত প্রাকৃতিক নিয়মে।
এই খন্ডে চারজন প্রথিতযশা বাঙালি দার্শনিক রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখা গ্রন্থিত হয়েছে। চিন্তা-চেতনায়, মননে ও বিষয়-বৈচিত্র্যে তাঁরা ভিন্ন। রামকৃষ্ণ ছিলেন একান্তই ভাববাদী ও একত্ববাদী দার্শনিক। বঙ্কিমকে ধর্মীয় ভাববাদী দার্শনিক হিসেবে আখ্যায়িত করাই অধিকতর শ্রেয়। অগাস্ট কোঁতের দৃষ্টবাদী দর্শনে প্রভাবিত রমেশচন্দ্র ইতিহাসকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং ধর্মীয় বিষয়কে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করার পক্ষপাতী। হরপ্রসাদ তাঁর দার্শনিক চিন্তায় বৌদ্ধ ধর্মসহ বিভিন্ন চিন্তাস্রোতের সন্ধান পেয়েছেন।
এ খন্ডে কবি-দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্বাচিত দার্শনিক প্রবন্ধগুলো স্থান পেয়েছে। তাঁর দর্শন পরিপুষ্ট ও বিকশিত হয়েছে গৌতম বুদ্ধের মৈত্রীভাবনা, যিশুখ্রিস্টের অনুপম প্রেম-মাধুর্য, আউল-বাউলদের সার্বজনীন মানবতাবাদ, বৈষ্ণবদের রস-সাধনা ও মরমিবাদীদের প্রেমধর্মের মাধ্যমে। সীমার মাঝে অসীমের মিলনসাধনাই তাঁর দর্শনের মূল সুর। রবীন্দ্রনাথ নিজ হৃদয়তন্ত্রীতে অনুভব করেছেন বিশ্বাত্মাকে, জীবনদেবতাকে, পরমব্রহ্মকে। জানতে চেয়েছেন অখ- সত্যকে, অনন্ত প্রেম ও পরিপূর্ণতাকে। এ কারণে দার্শনিক অভিধায় তাঁকে একত্ববাদী, একেশ্বরবাদী, সর্বেশ্বরবাদী, ভাববাদী, অতীন্দ্রিয় ভাববাদী নানাভাবে আখ্যায়িত করা যায়।
এ খন্ডে গ্রন্থিত স্বামী বিবেকানন্দের প্রবন্ধগুলোতে ফুটে উঠেছে তাঁর দর্শন-চিন্তার রূপরেখা। তাঁর দর্শনে দুটি বিষয় ক্রিয়াশীল বৈদান্তিক শংকরের অদ্বৈতবাদী বৈদান্তিক ধারা এবং গৌতম বুদ্ধের বিশ্বজনীন মানবতাবাদী চিন্তাধারা। এই দুটি ধারার সাথে নিজস্ব প্রাচ্য ও প্রতীচ্য-জ্ঞানের সমন্বয়ে তিনি নতুন ধারার সৃষ্টি করেন যা ‘ব্যবহারিক বেদান্ত’ নামে পরিচিত। এই ব্যবহারিক বেদান্তের কেন্দ্রবিন্দুতে এক পরমব্রহ্ম বিদ্যমান যার বহিঃপ্রকাশ মূর্তিমান মানুষের মধ্যে। মানুষ, মানুষের সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্না গুরু শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের উপদেশ ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’ ছিল তাঁর দর্শনের মূল উপজীব্য।
এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত দার্শনিক-বিজ্ঞানী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর প্রবন্ধগুলোতে তাঁর দার্শনিক চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়, যার ভিত্তিভূমি গড়ে উঠেছে বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করে। তিনি বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞানের সঙ্গে দার্শনিক যুক্তিবোধকে মিশিয়ে ও সমন্বিত করে জগৎ-রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘নিয়তিকৃত- নিয়মরহিত’ পরমসত্তা বা অতীন্দ্রিয় সত্তা নেই। জগৎ-সংসারে কোথাও নিয়মের ব্যতিক্রম নেই; সবকিছুই নিয়মের অধীন। আমাদের ভাগ্য তৈরি হয় কর্মের মাধ্যমে, অলৌকিক উপায়ে নয়। তিনি মনে করেন, দর্শনের শুরু হয় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের শেষে।
এতে সংকলিত হয়েছে শ্রীঅরবিন্দের গ্রন্থ ‘দিব্য-জীবন’ প্রথম খন্ড। অরবিন্দের দার্শনিক চিন্তার পটভূমিতে প্রভাব রেখেছে উপনিষদ, শংকরের অদ্বৈতবাদী ধারণা, রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী তত্ত্ব, পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানমুখী চিন্তাধারা। এসবের সমন্বয়ে তিনি স্বকীয় চিন্তায় এক নতুন দার্শনিক ধারার সূচনা করেন। তবে চিরায়ত দার্শনিক ভাবধারায় তিনি অতীন্দ্রিয় ভাববাদী, লীলাবাদী ও স্বজ্ঞাবাদী হিসেবে পরিচিত। অরবিন্দের দর্শনভূমি তাঁর নিজের জীবনের একান্ত অনুভূতি, যাকে তিনি ‘দিব্যজীবন’ নামে অভিহিত করেছেন। এই দিব্যজীবন লাভ মানুষের পক্ষেই সম্ভব, কারণ মানুষ স্বরূপতই ব্রহ্ম।
এতে স্থান পেয়েছে শ্রীঅরবিন্দের গ্রন্থ ‘দিব্য-জীবন’ দ্বিতীয় খন্ড। অরবিন্দের মতে, এই বিশ্বব্রহ্মা- পরমসত্তার লীলা-আনন্দের খেলা। কর্মফলে আসক্তিত্যাগ, অহংবোধ থেকে মুক্তি এবং পরমসত্তার ধ্যান-অনুধ্যানেই মানুষের মুক্তি। একমাত্র যোগ-সাধনার মাধ্যমে মানুষ হতে পারবে দেবমানব; যোগ-সাধনায় হবে তার মনের আমূল পরিবর্তন যা মানবকল্যাণে নিবেদিত হবে। অরবিন্দ তাঁর নিজস্ব দার্শনিক মতবাদের ভিত্তিতে উপনিষদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন এক মহিমাময় নবচেতনায়। তাঁর দার্শনিক ব্যাখ্যায় অধ্যাত্মসত্তার সঙ্গে মানবজীবনের সমন্বয়-স্বরূপের সন্ধান বিধৃত রয়েছে।
এই খন্ডে তিনজন বাঙালি দার্শনিকের চিন্তাধারা গ্রন্থিত হলো। বিষয়-বৈচিত্র্যে তাঁরা স্বতন্ত্র। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ ও উদার মননশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইসলামের দার্শনিকতত্ত্ব, সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য ও ইতিহাসকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। ভাববাদী ও একত্ববাদী দার্শনিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন সংস্কারমুক্ত সত্যসন্ধানী ‘জ্ঞানস্বামী’। মানবিক মূল্যবোধচর্চা ও অনুশীলনেই আজীবন ব্যাপৃত থেকেছেন, নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন জগৎ-জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তত্ত্বানুসন্ধানে। মানবেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন বিপ্লবী, জাতীয়তাবাদী, মার্কসবাদের অনুসারী। তিনি ছিলেন বস্তুবাদী, মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী এবং বৈশ্বিক চেতনায় সমৃদ্ধ।
এই খন্ডের উপজীব্য তিনজন বাঙালি দার্শনিকের চিন্তাধারা। ডা. লুৎফর রহমানের রচনার প্রধান বিষয় মানুষের নৈতিক চেতনা জাগ্রত ও উন্নত করা, উন্নত জীবনের পথের সন্ধান দেওয়া, মহৎ চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করা এবং সর্বোপরি মানুষের কল্যাণসাধন। এস. ওয়াজেদ আলির প্রবন্ধগুলো প্রকাশ করছে মানবতাবোধ, জীবনকে শিল্পে রূপায়ণের প্রচেষ্টা, পরমসত্তায় আত্মসমর্পণ, পারমার্থিক মূল্যবোধের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, ধর্মের ঐক্য ও সমন্বয়সাধন, সুফির অধ্যাত্মপ্রেমের প্রতি গভীর আকর্ষণ। দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী চার্বাক দর্শনকে নতুন আঙ্গিক ও প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন।
এই খ-ে যাঁদের রচনা রয়েছে তাঁদের মধ্যে আবুল হুসেন ছিলেন মৈত্রীকামী ও মানবতাবাদী চিন্তাবিদ। তাঁর রচনায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও উদার দর্শনের প্রতিফলন পাওয়া যাবে। কাজী মোতাহার হোসেন জগৎ-জীবনের দার্শনিক প্রশ্নকে ভাববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তিনি যুক্ত করেছেন মুক্তচিন্তা, উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কল্যাণকামী মনোভাব। মোহম্মদ বরকতুল্লাহর দার্শনিক চিন্তার ভিত্তি সার্বজনীন বিশ্বময় চেতনার অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর উদ্দেশ্য আত্মপ্রতিষ্ঠার চেতনাÑএই চৈতন্যশক্তিই বিশ্বের মূলসত্তা, বিশ্বের এক ও অদ্বিতীয় বস্তু।
এই খ-ে দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের রচনা স্থান পেয়েছে। ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে সমন্বয়সাধন করতে গিয়ে আরজ আলীর মনে যে জিজ্ঞাসার জন্ম হয় তা থেকেই তাঁর দর্শনচিন্তার শুরু। তিনি জগৎ-জীবনের মৌলিক প্রশ্নে যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিশীল দর্শনের অনুসারী। বস্তুবাদী দর্শনে অনুরক্ত হয়ে মানবজীবন, প্রকৃতি-পরিবেশ, জড়জগৎ, মানবসমাজ ইত্যাদি থেকে একধরনের দার্শনিক মতবাদে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। সংগ্রাম করেছেন গোঁড়ামি, অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও স্থবিরতার বিরুদ্ধে। এদিক থেকে তিনি বর্তমানকালের দুঃসাহসী জিজ্ঞাসু।
এই খ-ে আরজ আলী মাতুব্বরের ‘সৃষ্টি রহস্য’ ও ‘ভিখারীর আত্মকাহিনী’ গ্রন্থ দুটি সংকলিত হয়েছে। দ্বিতীয় গ্রন্থটি আত্মজীবনীমূলক। একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তির আত্মজিজ্ঞাসা, আত্ম-অনুসন্ধান আরজ আলীকে করে তুলেছে সত্যসন্ধ, সত্যান্বেষী। তাই তিনি বেছে নিয়েছেন স্বকীয় অনুসন্ধানের পথ। স্বশিক্ষায় আর অদম্য জ্ঞানস্পৃহার অন্বেষায় রচিত তাঁর গ্রন্থগুলো তাই স্থান করে নিয়েছে দর্শনের পরিম-লে, নিজেকে উন্নীত করেছেন দার্শনিকের মর্যাদায়। তাই তিনি যথার্থ অর্থেই দার্শনিক। তিনি প্রগতিশীল, প্রাগ্রসর চিন্তা, মুক্তমন ও মুক্তবুদ্ধির অধিকারী, বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনায় আত্মপ্রত্যয়ী।
দু’জন সাহিত্যিকের দর্শনচিন্তামূলক প্রবন্ধ এই খ-ে গ্রন্থিত হলো। মুহম্মদ এনামুল হক বিভিন্ন সাধক-গবেষকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, মসজিদ-দরগা, মাজারশরিফ পরিভ্রমণ করে জনশ্রুতি ও লোককাহিনি ব্যাখ্যা করে বঙ্গে সুফি-মতবাদের প্রচার, প্রসার ও বিকাশ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেন। তাঁর এই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ইতিহাসের এক ‘অনালোকিত’ অধ্যায়ের উন্মোচন ঘটে। আবুল ফজলের প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য সমাজ, সামাজিক কল্যাণ, মানুষ ও মানুষের মুক্তি, মানবপ্রীতি, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রভৃতি। তাঁর প্রবন্ধে আরো লক্ষ করা যাবে প্রগতিশীলতা, যুক্তিবাদিতা এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি।
এই খ-ে স্থান পেয়েছে দু’জন দার্শনিকের প্রবন্ধ। মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর অভিসন্দর্ভের অনুবাদ ‘বৈষ্ণব বেদান্ত’ গ্রন্থটি এতে গ্রন্থিত হয়েছে। তিনি বৈষ্ণব দর্শনের ধর্মতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, বিশ্বতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র প্রভৃতি আলোচনা করে এক নতুন দার্শনিক দিকের সূচনা করেন। এই আলোচনা আমাদের দর্শনের ইতিহাসে অনালোকিত অধ্যায় হিসেবে দীর্ঘদিন উপেক্ষিত ছিল। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ইসলামের বিশ্বজনীন তৌহিদভিত্তিক। এর আলোকে তিনি মানুষের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক কর্মকা- ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর রচনায় ‘অভেদ মানবতত্ত্ব’Ñমানবকল্যাণের বাণী সদা প্রকাশিত।
এই খ-ে গোবিন্দচন্দ্র দেবের মূল দার্শনিক গ্রন্থ ‘ভাববাদ ও প্রগতি’, আত্মজীবন সংশ্লিষ্ট গ্রন্থ ‘আমার জীবন-দর্শন’ এবং গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রবন্ধ গ্রন্থিত হলো। তাঁর দর্শন ‘সমন্বয়ী দর্শন’ নামে সমধিক পরিচিত। তিনি একদিকে যেমন সর্বধর্ম সমন্বয় করে বিশ্বজনীন মানবতাবাদের কথা বলেছেন, অন্যদিকে চিরায়ত ভাববাদ ও বস্তুবাদের সমন্বয় করে সমন্বয়ী ভাববাদের কথা বলেছেন। তাই তিনি ভাববাদী দার্শনিক। তিনি ভাববাদকে ‘প্রগতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর জীবনদর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মানুষ ও মানুষের কল্যাণাকাক্সক্ষা।
এই খ-ে চারজন চিন্তাবিদের রচনা মুদ্রিত হয়েছে। ভবানী সেন মার্কসবাদী ভাবাদর্শের অনুসারী। তিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্য দর্শনের মার্কসীয় ব্যাখ্যা প্রদান করেন। সাইদুর রহমান সমাজব্যবস্থা হিসেবে মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য বিশ্বাস করতেন সমাজতন্ত্রে। ভবতোষ দত্ত তাঁর ‘বাঙালি মানসে বেদান্ত’ গ্রন্থে বাঙালির মানস ও সমাজজীবনে বেদান্তের কার্যকর প্রভাবের চিত্র তুলে ধরেছেন। আহমদ শরীফ দর্শনের বিষয়গুলোকে বস্তুবাদী ও উপযোগবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। মার্কসীয় ধ্যান-ধারণা, আন্তর্জাতিকতাবাদ, মানবতাবাদ, গণকল্যাণপন্থি চিন্তা তাঁর উপজীব্য।
এই খ-ে খ্যাতিমান সমাজতাত্ত্বিক ও সাম্যবাদী লেখক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোকায়ত দর্শন’ গ্রন্থটি সংকলিত হয়েছে। তাঁর গবেষণার মূল বিষয়বস্তু ভারতবর্ষ হলেও লোকসংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত শাস্ত্রবিরোধিতায় তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ভারতীয় ঐতিহ্যের ‘বিকল্প সংজ্ঞার নির্মাণকারক’। এই বিনির্মাণে তিনি দর্শন ও বিজ্ঞানের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণি-বিশ্লেষণ, দর্শন এবং মতাদর্শের রাজনৈতিক ভূমিকার কথা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেছেন; শেষের দিকে চিন্তা করেছেন বিজ্ঞানচেতনার সঙ্গে ‘মানবিক দায়িত্ববোধ’ ও ‘নৈতিকতা’র প্রশ্নটি সংযোজনের, মানবকল্যাণে প্রয়োগের।
এই খ-ে স্থান পেয়েছে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রন্থ ‘ভারতীয় দর্শন’ (প্রথম খ-)। দেবীপ্রসাদ তাঁর গবেষণায় ও রচনায় দেখাতে চেষ্টা করেন ভারতের দীর্ঘদিনের লালিত জাতিভেদ প্রথা এবং বেদান্তের মায়াবাদী দর্শন বস্তুবাদী ধারাকে উপেক্ষা করেছে, যা ভারতের অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়। তাঁর বিকল্প মূল্যায়নে সূচিত হয়েছে গবেষণার এক নতুন দ্বার, পাওয়া গিয়েছে এক নতুন গভীরতা। তিনি তাঁর গবেষণায় দেখালেনÑবেদ-বেদান্তের বিজ্ঞান-বিরোধিতা, লোকায়ত-ন্যায়-সাংখ্যের বিজ্ঞানভিত্তিক উপাদান ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, সিন্ধুসভ্যতার অবদান প্রভৃতি। তাঁর ভূমিকা ভারতবিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয়।
বর্তমান খ-ে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে’ গ্রন্থটি ছাড়াও চারজন প্রথিতযশা দার্শনিক আবদুল মতীন, রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, আমিনুল ইসলাম ও নীরুকুমার চাকমার প্রতিনিধিত্বমূলক কয়েকটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। প্রবন্ধগুলোর মধ্যে রয়েছে আবদুল মতীনের ‘জীবন-জিজ্ঞাসা’ ও ‘দর্শনচর্চা ও আমাদের সমস্যা’; রমেন্দ্রনাথ ঘোষের ‘মানবকল্যাণে শিক্ষা’ ও ‘বাঙালির দার্শনিক আদর্শ : সামাজিক মানবতাবাদ’; আমিনুল ইসলামের ‘বাঙালির দর্শন’ ও ‘আমার জীবনদর্শন’ এবং নীরুকুমার চাকমার ‘বৌদ্ধধর্ম ও বিজ্ঞান’ ও ‘মানবতাবাদ