Arthoniti Chinta
Arthoniti Chinta

সম্পাদক পরিচিতি

বিজ্ঞানচিন্তার খন্ড সমূহ

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শিল্প-সাহিত্য, পাশ্চাত্য ও প্রাচীন ভারতীয় দর্শন, নাটক-রম্যরচনার পাশাপাশি বিজ্ঞানবিষয়ক রচনায় মনোনিবেশ করতে লেখকদের উদ্বুদ্ধ করতেন। পাশাপাশি উপন্যাসের মতো বিজ্ঞানরচনার ক্ষেত্রে নিজেই গ্রহণ করেন পথপ্রদর্শকের ভূমিকা। ‘বঙ্গদর্শনে’ একের পর এক প্রকাশিত হয়ে চলল তাঁর লেখা বিভিন্ন বিজ্ঞানবিষয়ক নিবন্ধ। সেইসব রচনারই সংকলন হচ্ছে ‘বিজ্ঞানরহস্য’। অধুনা দুষ্প্রাপ্য এই রচনাপুঞ্জ দিয়েই শুরু ‘বাঙালির বিজ্ঞানচিন্তা’র প্রথম খন্ড। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু ও স্বর্ণকুমারী দেবীর রচনাগুলো এ খন্ডকে সমৃদ্ধ করেছে।

এই খন্ডে সন্নিবেশিত হয়েছে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী রচিত চব্বিশটি প্রবন্ধ। তাঁর অন্যতম প্রধান গুরুত্বের জায়গা হচ্ছে দৃষ্টিনিক্ষেপের বহুকৌণিকতা এবং বিজ্ঞানকে একটি চলিষ্ণু বিষয় হিসেবে ব্যাখ্যার চেষ্টা করা। তাঁর দৃঢ় উপলব্ধি ছিল যে আজ না পারলেও বিজ্ঞান একদিন সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে সমর্থ হবে। বিজ্ঞানচিন্তা বলতে রামেন্দ্রসুন্দর প্রকৃত বিজ্ঞানচিন্তা ও দর্শনকেই যে বুঝিয়েছেন, বিজ্ঞানের যান্ত্রিক দিক যে তাঁর কাছে বড় হয়ে ওঠেনি কখনো। তাঁর মতে, মানুষ অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করে অভ্যাস এবং সংস্কারবশত। জ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাসও কমে আসবে।


সেকালে বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজনীতি ও ধর্মনীতির ছিল প্রত্যক্ষ যোগ। একমাত্র মানবকল্যাণ ব্যতীত অন্য কোনো কর্মে বিজ্ঞানকে নিয়োগ করা হত না। আত্মাভিমান জন্মায়--এই ভয়ে অনেক আবিষ্কারক নিজের নাম পর্যন্ত গোপন রাখতেন। অর্থাৎ ব্যক্তিগত বিজ্ঞানসাধনাকেও তাঁরা সামাজিক সম্পত্তি মনে করতেন। লক্ষণীয়, এই চিন্তাধারার আধুনিক অনুসারী ছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। নিজের আবিষ্কারসমূহের কোনো পেটেন্ট ঘোষণা না করার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন যে তাঁর আবিষ্কারসমূহ মানবজাতির সম্পদ হিসেবে অবারিত থাকুক।

১৯৪৭-উত্তর সময়ে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের শিক্ষিত অংশের মধ্যে কিছুটা বিজ্ঞানচিন্তা পরিব্যাপ্ত হয়। এ সময়ে বাঙালি মুসলমান বেশি মাত্রায় বিজ্ঞানপাঠে উদ্বুদ্ধ হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে এই ধারা যে অধিকতর বেগবান হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। একাত্তর-পরবর্তী সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে বা জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বিজ্ঞানচিন্তার প্রয়োজনীয়তা বেশি করে অনুভূত হয়। প্রকাশিত হতে থাকে বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন পত্রিকা, সাময়িকী ও গ্রন্থ। অনেক নতুন বিজ্ঞানলেখক ও চিন্তকের আবির্ভাব ঘটে এই সময়ে। এই খন্ডে তেমন কিছু লেখা সংকলিত হয়েছে।


এই খন্ডে সংকলিত হয়েছে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও রমাকৃষ্ণ মৈত্র লিখিত গ্রন্থ ‘পৃথিবীর ইতিহাস’। পৃথিবীর ইতিহাস বলতে বোঝানো হয়েছে বিবর্তনের ইতিহাস-- প্রাণিজগতের বিবর্তন, মানুষের বিবর্তন, মানুষের সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতার বিবর্তন। তারও পূর্বে রয়েছে সৌরজগতের, সূর্যের ও পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে অদ্যাবধি ভৌত বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ও মনোগ্রাহী ধারাক্রম।  এতে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্পর্কে যেমন, তেমনই আলোচনা করা হয়েছে হেনরি লুইস মর্গানের মানবসমাজের বিবর্তনবাদের কথাও।

মানুষ তার বুদ্ধিগ্রাহ্য চেতনার উন্মেষলগ্ন থেকেই গ্রহ-নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছিল। সেই অর্থে জ্যোতির্বিজ্ঞান পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন বিজ্ঞান। বাঙালির বিজ্ঞানচিন্তাতেও জ্যোতির্বিজ্ঞান উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আবদুল্লাহ আল-মুতী পর্যন্ত বিশাল এক লেখকগোষ্ঠী জ্যোতির্বিজ্ঞান-বিষয়ক বিবিধ বই লিখেছেন। তবে শঙ্কর চক্রবর্তীর ‘জ্যোতির্বিদ্যার গোড়ার কথা’ রচনাটি অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন সবার জন্য পাঠ-উপযোগী হয়ে উঠেছে । এই খন্ডে সংকলিত রচনাগুলো বাংলায় বিজ্ঞানচিন্তার স্বচ্ছ দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।


প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানভাণ্ডারের এক ক্ষুদ্রতম অংশমাত্র উত্তরপ্রজন্মের হাতে পৌঁছেছে। বর্তমান পৃথিবীর জ্ঞানকেন্দ্র পাশ্চাত্য। তাই এখন বাঙালির বিজ্ঞানচিন্তাও মূলত পাশ্চাত্যের অনুরূপ। পাশ্চাত্যবিজ্ঞানের ধারাকে দেশীয়করণের চেষ্টাতেই মূলত বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা নিবেদিত। সেই কারণে সৃষ্টি-বিষয়ক সর্বশেষ চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হতে না পারলে তত্ত্বীয় জ্ঞানচর্চায় অনেকটা পিছিয়ে পড়তে হবে। বিজ্ঞানচিন্তা কোনো সংজ্ঞাবদ্ধ, অখন্ড, অবিভাজ্য চেতনা নয়। বরং তা বহুমুখী এবং সুদূরপ্রসারী। এ খন্ডে বাংলার বিজ্ঞানচিন্তকরা নানামুখী রচনার মাধ্যমে এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন।

এদেশে প্রাচীনকালে বিজ্ঞানের চর্চা কিছুটা ছিল। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানচর্চা কিংবা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে বাঙালির মৌলিক অবদানের নজির মেলেনি। বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান এসেছে ইউরোপীয়দের হাত ধরে। বাঙালি চিন্তাবিদরা বিজ্ঞানচিন্তাকে আমজনতার মধ্যে সঞ্চারিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ঔপনিবেশিক আমলেও-ঔপনিবেশিক-উত্তর সময়েও। কেননা আধুনিক বিজ্ঞানচিন্তার পরিবর্তে রাষ্ট্র মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা এবং সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ জিইয়ে রাখতে কাজ করেছে। তাই বাঙালির বিজ্ঞানচিন্তাকে রাষ্ট্রশক্তির আনুকূল্যহীনতার মধ্যে টিকে থাকতে হয়েছে এবং হচ্ছে। বাঙালির বিজ্ঞানচিন্তার এটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।