সম্পাদক পরিচিতি
ভাষাচিন্তার খন্ড সমূহ
বাঙালির ভাষাচিন্তা-র বর্তমান প্রথম খন্ডে অন্তর্ভুক্ত দু’টি ভাগ : প্রথম ভাগ--‘বাংলা ভাষার ইতিহাস’, দ্বিতীয় ভাগ--‘বাংলা ভাষাচর্চার ইতিহাস ও ভাষাচর্চার কাঠামো’।
বাংলা ভাষার ইতিহাস-নির্মাণের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে পুরো উনিশ শতক জুড়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণার জন্ম হয়নি। এই সময়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব-সংক্রান্ত ধারণাটি ছিল ভাসা-ভাসা। জনসাধারণ্যে তখন যে-ধারণাটি প্রবল ছিল তা হলো, বাংলা ভাষা উদ্ভূত হয়েছে সংস্কৃত থেকে অর্থাৎ বাংলা সংস্কৃতের দুহিতা। ভাষাশাস্ত্রের যে-শাখায় ভাষার উদ্ভব ও বিকাশের বিষয়টি আলোচিত হয়, তা তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান। যদিও পুরো উনিশ শতক এবং বিশ শতকের অন্ততপক্ষে প্রথম পনেরো বছর সমগ্র বিশ্ব জুড়ে এই শাখাটি প্রবল প্রতাপে বিরাজিত ছিল এবং যার জন্ম হয়েছিল বাংলাভাষী অঞ্চলেই, ১৭৮৬-র কোলকাতায়, তবুও এই অঞ্চলে এই শাখার আশ্রয়ে বাংলা ভাষার ইতিহাস উদ্ঘাটনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও শতাধিক বছর। বাংলা ভাষার উদ্ভব বিষয়ে যা জানার তা হলো, বাংলা ভাষা উৎসারিত হয়েছে কোন মূল ভাষা থেকে, কোন সময়ে এবং কোন অঞ্চলে। তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান উদ্ভবের এক শ’ সতেরো বছর পর জর্জ আব্রাম গ্রিয়ারসন এইরূপ সুস্পষ্ট মত প্রকাশ করেন যে মাগধী (যার প্রচলিত নাম প্রাকৃত) ভাষার কোনো পূর্বাঞ্চলীয় রূপ থেকেই উদ্ভূত হয়েছে বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষা যে সংস্কৃতের জঠর-উদ্ভূত নয়, সে বিষয়ে গ্রিয়ারসনের এই মত প্রকাশের তিন দশক পূর্বে রামগতি ন্যায়রত্ন নিম্নরূপ মত প্রকাশ করেছিলেন : ‘অনেকে কহিয়া থাকেন যে, সংস্কৃত ভাষা বাঙ্গালার জননী--অর্থাৎ পূর্বোল্লিখিত সংস্কৃত হইতেই বাঙ্গালাভাষা উৎপন্ন হইয়াছে। কিন্তু আমাদের তাহা বোধ হয় না; আমাদের বোধে বাঙ্গালা সাক্ষাৎ সম্বন্ধে সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন নহে, কিন্তু পরম্পরা সম্বন্ধে’।
বর্তমান খন্ডের ‘বাংলা ভাষার ইতিহাস’ শীর্ষক ভাগে পাঁচটি এবং ‘বাংলা ভাষাচর্চার ইতিহাস ও ভাষাচর্চার কাঠামো’ শীর্ষক দ্বিতীয় ভাগে তেরটি মিলিয়ে সর্বমোট আঠারটি রচনা সংকলিত হলো।
বাঙালির ভাষাচিন্তা-র বর্তমান দ্বিতীয় খন্ডের শিরোনাম ‘ধ্বনিতত্ত্ব’।
মানুষ বাক্প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে যত ধ্বনি উৎপাদন করতে পারে, তার সবকটিই ভাষায় ব্যবহারযোগ্য নয়। যেসব ধ্বনি ভাষায় ব্যবহারযোগ্য অথবা উলটো করে বললে--ভাষায় ব্যবহৃত হয় যেসব ধ্বনি, সেগুলোকে চিহ্নিত করা হয় ‘ভাষিক ধ্বনি বা বাগ্ধ্বনি হিসেবে। হিন্দুপুরাণ মতে ধ্বনিচর্চা প্রথম সম্পন্ন হয়েছিল স্বর্গধামে। ভাষা যেহেতু অবিরাম বাক্স্রোত, সেহেতু কী অভ্যন্তরীণ উপাদানে গড়ে উঠেছে এই বাক্স্রোত, এটি জানতে স্বর্গস্থিত সকল দেবতা স্বর্গাধিপতি ইন্দ্রের শরণাপন্ন হন। দেবরাজ ইন্দ্র দীর্ঘ বিশ্লেষণ শেষে পেলেন ধ্বনি। এ-সূত্রে বলা যায়, ইন্দ্রই প্রথম ধ্বনিবিজ্ঞানী। কিন্তু পৌরাণিক ব্যাখ্যা দিয়ে তো আর বিজ্ঞান চলে না, ফলে ধ্বনিচর্চার জন্য আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় ভাষাবিজ্ঞানের।
বাগ্ধ্বনির চর্চায় নিবেদিত দুটি শাস্ত্র : এক. ধ্বনিবিজ্ঞান (ফনেটিক্স্), এবং দুই. ধ্বনিতত্ত্ব (ফনোলজি)। প্রথমটি ভাষাবিজ্ঞানের অঙ্গীভূত কি না, এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও দ্বিতীয়টি অবিতর্কিতভাবেই ভাষাবিজ্ঞানভুক্ত। ধ্বনিবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয় যেখানে ভাষায় ব্যবহারযোগ্য ধ্বনিসমূহের ভৌত বৈশিষ্ট্যের আলোচনা, সেখানে ধ্বনিতত্ত্ব হলো ধ্বনিসমূহ ভাষায় কী সংগঠনে বিন্যস্ত হয়, তার আলোচনা। ধ্বনিবিজ্ঞান এবং ধ্বনিতত্ত্বের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজনরেখা সৃষ্টিতে ব্যয়িত হয়েছে সুদীর্ঘকাল।
বর্তমান খন্ডে সংকলিত হলো মোট তেইশটি রচনা। এ-রচনাগুলোর দু’একটি ছাড়া সবকটিই বাংলা ভাষার ধ্বনি বিষয়ে। বাঙালির ধ্বনিচিন্তা যে নগণ্য ব্যতিক্রম বাদে যে সর্বাংশেই বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক, এই রচনা-সংকলনে ঘটেছে তারই প্রতিফলন।
বাঙালির ভাষাচিন্তা-র বর্তমান তৃতীয় খন্ডের শিরোনাম ‘রূপতত্ত্ব’।
প্রথাগত ব্যাকরণের গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ‘শব্দ’-কে পরিহার করে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয় ‘রূপ’ ধারণাটি। প্রথাগত ব্যাকরণের ‘শব্দ’ এবং আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের ‘রূপ’ অনেকাংশেই পৃথক। ভাষাবিজ্ঞানের যে শাখা শব্দের গঠন বর্ণনা-বিশ্লেষণ করে, তা-ই রূপতত্ত্ব। রূপতত্ত্বের ইংরেজি ‘মরফলজি’ শব্দটির উৎস গ্রিক এবং শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি-তে, ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে। বস্তুত, শব্দের অভ্যন্তরীণ সংগঠন এবং যেসব নিয়মের মারফতে শব্দাবলি গড়ে ওঠে, সে আলোচনাই রূপতত্ত্ব। রূপতত্ত্বানুসারে ক্ষুদ্রতম বাক্যিক একক হলো রূপমূল। এই রূপমূল গড়ে ওঠে এক বা একাধিক ধ্বনি সহযোগে এবং এই রূপমূলের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয় কোনও অর্থ বা অর্থের রেশ। রূপতত্ত্বের প্রধান ভাগ দু’টি : ‘সাধিত রূপতত্ত্ব’ এবং ‘সম্প্রসারিত রূপতত্ত্ব’ (দ্র. অ্যাকমাজিয়ান (১৯৯৬, ৩৬))। সাধিত রূপতত্ত্বে আলোচিত হয় নানা শ্রেণির নতুন শব্দগঠন কৌশল, আর সম্প্রসারিত রূপতত্ত্বে আলোচিত হয় শব্দসমূহ বাক্যে ব্যবহৃত হওয়ার সময় যে রৌপ-পরিবর্তন ঘটে, তা। আর এ-জন্যই সাধিত রূপতত্ত্ব হলো প্রকৃতার্থে শাব্দ রূপতত্ত্ব, সম্প্রসারিত রূপতত্ত্ব হলো প্রাত্যয়িক রূপতত্ত্ব। অর্থহীন ধ্বনির সাহায্যে অর্থপূর্ণ রূপমূল সৃষ্ট হয় বলে রূপতত্ত্বের সঙ্গে ধ্বনিতত্ত্বের যেমন সম্পর্ক রয়েছে, বাক্যে ব্যবহৃত হওয়ার সময় রূপমূলের আকৃতিগত পরিবর্তন ঘটে বলে রূপতত্ত্বের সঙ্গে বাক্যতত্ত্বেরও তেমন সম্পর্ক রয়েছে।
বর্তমান খন্ডে সংকলিত হলো মোট বিশটি রচনা। এ-রচনাগুলোর সবকটিই বাংলা ভাষা বিষয়ে। বাঙালির রৌপচিন্তা যে নগণ্য ব্যতিক্রম বাদে সর্বাংশেই বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক, এই রচনা-সংকলন সে-দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে।
বাঙালির ভাষাচিন্তা-র বর্তমান চতুর্থ খন্ডের শিরোনাম ‘বাক্যতত্ত্ব’।
ভাষামাত্রেই রয়েছে যে চারটি আবশ্যকীয় উপাদান, তার একটি বাক্য। বলার অপেক্ষা রাখে না যে অন্য তিনটি হলো ধ্বনি, রূপ ও অর্থ। ধ্বনি সমন্বয়ে গড়ে ওঠে রূপ, আর ধ্বনি ও রূপ সমন্বয়ে গড়ে ওঠে বাক্য। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষারই বাক্যসংখ্যা অপরিমেয়। ভাষা মানেই তাই অসীম বাক্য-সমবায়। ভাষার এই বাক্যিক অসীমতার কারণটি কী-অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে। যে-কোনো ভাষার বাক্য গঠনের রয়েছে বিচিত্র নিয়ম। বাক্য হতে পারে একশাব্দিক, দ্বিশাব্দিক, ত্রিশাব্দিক--এভাবে শব্দের পর শব্দ বসিয়ে বসিয়ে দীর্ঘাকৃতির। কোনো ভাষার দীর্ঘতম বাক্যটি গড়ে উঠতে পারে ক’টি শব্দ সমন্বয়ে, তার কোনো হিসাব সম্ভব নয়। কারণ, এ-ক্ষেত্রে বাক্যের ধরন, বাক্য-স্রষ্টার মানসিকতা, প্রতিবেশ-পরিস্থিতিই মুখ্য। এ-তো গেল এক দিককার কথা। বৈচিত্র্য সৃষ্টি হতে পারে শব্দ-নির্বাচনে, শব্দ-ক্রমে, বাক্যাংশ ও খ-বাক্যের কাঠামো ও বিন্যাসেও। এ-সূত্রেই সম্ভব সীমাহীন বাক্য সৃষ্টি।
বর্তমান খন্ডে সংকলিত হলো মোট বাইশটি রচনা। রচনাগুলোর প্রথম আটটি প্রথাগত ধারায় রচিত, বাকিগুলো রচিত বর্ণনামূলক ও রূপান্তরমূলক ধারায়।
বাঙালির ভাষাচিন্তা-র বর্তমান পঞ্চম খন্ডে অন্তর্ভুক্ত দুটি ভাগ : প্রথম ভাগ--‘বাগর্থবিজ্ঞান’, দ্বিতীয় ভাগ--‘অভিধানবিজ্ঞান’।
‘ডিক্শনারি’ শব্দের চলন সতেরো শতকের প্রথমার্ধে হলেও ডিক্শনারি বা অভিধান সংকলন কিন্তু এই সময় থেকেই নয়। বস্তুত অভিধান সংকলন-কর্মটি বহু প্রাচীন। অভিধান সংকলনের প্রাচীনতম প্রয়াস লক্ষ করা যায় সুমেরীয় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে। এতে পাওয়া গেছে এমন কিছু মৃত্তিকা-ফলক (ক্লে ট্যাবলেট), যেগুলো বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে অভিধানই। কারণ এসব ফলকে সুমেরীয় শব্দের সঙ্গে তাদের সেমীয়-অ্যাসিরীয় অর্থনির্দেশের প্রয়াস রয়েছে [সরস্বতী (২০০০, ২০)]। অভিধানচর্চার নিদর্শন পাওয়া গেছে প্রাচীন চীনেও, খ্রিস্টপূর্ব এগারো শতকে। ভেবে অবাক হতে হয়, যখন ছাপাখানা তো বহু দূরের কথা, কাগজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি, তখনও তৈরি হয়েছে অভিধান, যদিও বর্তমানে যে-বৈশিষ্ট্যে অভিধানকে চিহ্নিত করা হয়, তেমনটি নয়। এ-দুইকে যদি অভিধান বলতে বাধেও, তবে এদেরকে ‘শব্দতালিকা’ বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এরপর অভিধানসৃষ্টির উল্লেখযোগ্য প্রয়াস লক্ষণীয়। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে হোমারের রচনাকর্মে যে-সমস্ত অপরিচিত এবং দুরূহ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছিল, সেগুলোর সংকলন করা হয়েছিল এ-সময়ে [দ্র. ক্রিস্টাল (১৯৮৭, ১১১)]।
বর্তমান খ-ের ‘বাগর্থবিজ্ঞান’ শীর্ষক ভাগে তেরটি এবং ‘অভিধানবিজ্ঞান’ শীর্ষক দ্বিতীয় ভাগে উনিশটি মিলিয়ে সর্বমোট বত্রিশটি রচনা সংকলিত হলো। বাঙালির বাগর্থ এবং অভিধানচিন্তা যে নগণ্য ব্যতিক্রম বাদে সর্বাংশেই বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক, এই রচনা-সংকলনে তারই প্রমাণ মিলবে।
বাঙালির ভাষাচিন্তা-র বর্তমান ষষ্ঠ খন্ডে অন্তর্ভুক্ত দুটি ভাগ : প্রথম ভাগ--‘পরিভাষাতত্ত্ব’ এবং দ্বিতীয় ভাগ--‘শৈলিবিজ্ঞান’।
বৈশ্বিক পরিম-লের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে তখন শুরু করতে হয় অনুন্নত ভাষাটির আধুনিকায়ন প্রচেষ্টা; আশ্রয় নিতে হয় ভাষা পরিকল্পনা শাস্ত্রের। এই শাস্ত্রটি তখন সরবরাহ করে এমন গুচ্ছ গুচ্ছ নির্দেশনা, যার মাধ্যমে নির্মাণ করা সম্ভবপর হয় কার্যোপযোগী পারিভাষিক শব্দসম্ভার; ক্রমান্বয়ে সম্পন্ন হতে থাকে ভাষাটির আধুনিকায়নও। ফার্গুসন মত প্রকাশ করেছেন যে ভাষা আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার একটি বড় উপাদান হলো বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও অন্যান্য আধুনিক শাস্ত্রচর্চার উপযোগী পারিভাষিক শব্দ সৃষ্টি ও শব্দ গঠনের নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন (১৯৭৭)। আধুনিক জ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্রটি যেহেতু বর্তমানে পশ্চিম গোলার্ধ এবং যেহেতু তা নিষ্পন্ন হয় ইংরেজিসহ প্রধানত পশ্চিম ইউরোপীয় ভাষাগুলোর মাধ্যমে, ফলে পূর্ব গোলার্ধে এই জ্ঞানচর্চা প্রবহমান রাখতে ওই ভাষাগুলো থেকে ধার নিতে হয় ধারণাসমূহের এবং নির্মাণ করে যেতে হয় গুচ্ছ গুচ্ছ পারিভাষিক শব্দের। এভাবেই প্রবহমান থাকে অনুন্নত ভাষার আধুনিকায়ন প্রক্রিয়াও। বাংলা ভাষায় এ-কর্মটি সাধিত হচ্ছে সোয়া দু’শ বছর ধরে।
এই খন্ডে সংকলিত হলো মোট ছাব্বিশটি রচনা। এগুলোর মধ্যে পরিভাষা সম্পর্কিত রচনা বাইশটি এবং শৈলী সম্পর্কিত রচনা চারটি।
বাঙালির ভাষাচিন্তা-র বর্তমান সপ্তম খন্ডে অন্তর্ভুক্ত হলো ‘উপভাষাতত্ত্ব (ক. আঞ্চলিক ভাষা, খ. সমাজভাষা, গ. লোকভাষা)’
পন্ডিতবর্গ এবং ভাষাবিজ্ঞানীমহলের প্রসঙ্গ ব্যতিরেকে সারা বিশ্বজুড়ে যে-আমজনতা, এই আমজনতার উপভাষার প্রতি মনোভাবটি তেমন একটা সম্মানজনক নয়। এ-মনোভাবের কারণটিও দুর্লক্ষ্য নয়। সাধারণভাবে শব্দটি নির্দেশ করে ভাষার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম সম্মানজনক ভাষার প্রতি। আরও বিস্তৃত এবং সুস্পষ্ট করে বলা যায়, নগণ্য ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সকল মানুষের কাছে উপভাষা হলো অনুন্নত-অসংস্কৃত-বিকৃত। বিকৃতির ধারণাটি গড়ে উঠেছে এই ভ্রান্তি থেকে যে ভাষা বিকৃত হলেই তা হয়ে ওঠে উপভাষা তথা আঞ্চলিক ভাষা। কিন্তু আসল সত্য হলো, উপভাষা কোনও বিচারেই অনুন্নত, অসংস্কৃত বা বিকৃত ভাষা নয়; বিশেষ কোনও ভাষার পরিবর্তন বা বিকৃতিতেও গড়ে ওঠে না কোনও উপভাষা। বরং উপভাষাই হলো অকৃত্রিম ভাষা। ম্যাক্স্মুলার যথার্থই বলেছেন যে ‘ভাষার প্রকৃত এবং স্বাভাবিক জীবন তাহার উপভাষাগুলোতে’ [দ্র. মুহম্মদ (১৯৭৩, ঝ)]। বিশেষ কোনও আঞ্চলিক উপভাষাই (রিজিওনাল ডায়ালেক্ট) যখন শিক্ষিত ও অভিজাত সম্প্রদায়ের পরিচর্যায় ও স্বীকৃতিতে অপেক্ষাকৃত বৃহত্তর পরিম-লে প্রচলন-যোগ্যতা অর্জন করে, তখন তা-ই ‘ভাষা’ নামে আখ্যায়িত হয়। এই প্রচলন-যোগ্যতা অর্জনের পথে উপভাষাই বরং কিছুটা অকৃত্রিমতা হারিয়ে ভাষার রূপ লাভে সক্ষম হয়েছে। এই সূত্রেই গাঙ্গেয় উপত্যকার উপভাষা বাংলা ভাষার মর্যাদা লাভে সক্ষম হয়েছে। বস্তুত, ভাষা ও উপভাষার পার্থক্যটি চূড়ান্ত নয়, আপেক্ষিক; শ্রেণিগত নয়, মাত্রাগত।
বর্তমান খন্ডে ‘আঞ্চলিক ভাষা’ বিষয়ক নয়টি, ‘সমাজভাষা’ বিষয়ক তেইশটি এবং ‘লোকভাষা’ বিষয়ক তিনটি মিলিয়ে মোট পঁয়ত্রিশটি রচনা সংকলিত হলো।
বাঙালির ভাষাচিন্তা-র বর্তমান অষ্টম খন্ডের শিরোনাম ‘ভাষা পরিকল্পনা’।
বিশেষ কোনও বছরকে যদি ভাষা পরিকল্পনা-ধারণার জন্ম বছর বলে নির্দেশ করতে হয়, তবে তা করতে হয় ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দটিকে। কারণ এই বছরেই উরিয়েল ভাইনরাইখ (১৯২৬-৬৭) কর্তৃক প্রথম ব্যবহৃত হয় ীটভথলটথণ ফেটভভধভথ অভিধাটি, যা থেকে এই নামেই গড়ে ওঠে ভাষাবিজ্ঞানের প্রবল পরাক্রমশালী, বহুচর্চিত এই শাখাটি [দ্র. দিল (১৯৭২, ২০০৯)]। ওই বছরের ডিসেম্বরে তিনি শিকাগোতে আয়োজিত ‘আমেরিকার নৃতাত্ত্বিক সমিতি’-র এক সেমিনারে কদণ করমলঠফণ্র মত ঔধভঢধ শীর্ষক আরও একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, যার মাধ্যমে তিনি ভাষা-সমস্যার প্রকৃতি নির্দেশে সচেষ্ট হয়েছিলেন [দ্র. ফিশম্যান (১৯৭৬, ১৫)]। অবশ্য এ দুই উপস্থাপনের চার বছর আগে, ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে, তিনি ীটভথলটথণ্র ধভ উমর্ভটর্ড নামে রচনা করেছিলেন একটি গ্রন্থ, যেখানে ‘একটি সংকেত হিসেবে প্রমিত ভাষা’ শীর্ষক অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন ‘ভাষা আনুগত্যের উৎস’ এবং ‘প্রমিতকরণের উপযোগিতা’ বিষয়ক বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য। এখানে তিনি হিব্রু এবং আইরীয় ভাষার উদাহরণ টেনে প্রশ্ন তুলেছিলেন যে যদি দেড় শ’ বছর আগেকার অর্ধমৃত ভাষাকে পুনরুজ্জীবন করা যায়, তবে সে-জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কেন ভাষা উন্নয়নে কাজে লাগানো যাবে না; তিনি চেক ও রোমানীয় ভাষার উদাহরণ টেনে বলেছেন, ভাষার প্রমিতকরণে এ-দুইও লক্ষণীয় কৃতকার্যতা অর্জন করেছে।
বর্তমান খন্ডে সংকলিত হলো মোট তেষট্টিটি রচনা। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সীমারেখাজনিত ভিন্নতার কারণে এ দেশের এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রবন্ধগুলোতে পরিদৃষ্ট হয় প্রকৃতিগত ভিন্নতা।
বাঙালির ভাষাচিন্তা-র বর্তমান নবম খন্ডের শিরোনাম ‘লেখনরীতিচর্চা’।
পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ উভয় আমলেই লেখনরীতিচর্চায় ঠাঁই পেয়েছে আরও একটি বিষয়, সেটি হলো প্রতিবর্ণীকরণ বা লিপ্যন্তর। সহস্রাধিক বছরের বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে আরবি-ফারসি-ইংরেজিসহ বহু ভাষার শব্দ। এই সমস্ত বিদেশি শব্দ বাংলায় লিখতে গিয়ে ব্যক্তিরুচির ব্যাপক প্রতিফলন ঘটায় বানান হয়ে উঠেছে অসম। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আবদুল হক, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, সুভাষ ভট্টাচার্য, ভূদেব বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকেই এ-বিষয়ে লেখনিধারণ করেছেন। তবে উল্লেখ্য যে এ-সংক্রান্ত সিংহভাগ আলোচনাই সীমাবদ্ধ থেকেছে আরবি-ফারসি এবং ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ বিষয়ে। অপরাপর ভাষার শব্দের বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ খুব একটা প্রাধান্য পায়নি। বাংলা শব্দের রোমক প্রতিবর্ণীকরণের আলোচনা প্রায় শূন্য। উভয়ের জন্যই বিধি-প্রণয়ন কাম্য।
বর্তমান খন্ডে সংকলিত হলো মোট পঁয়তাল্লিশটি রচনা। রচনাগুলোর সবকটিই বাংলা এবং এতদঞ্চলের লেখনসংক্রান্ত। বাঙালির লেখনচিন্তা যে নগণ্য ব্যতিক্রম বাদে সর্বাংশেই বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক, এই রচনা সংকলনে ঘটেছে তারই প্রতিফলন।
বাঙালির ভাষাচিন্তা-র বর্তমান দশম খন্ডের শিরোনাম ‘বিবিধ’।
প্রথাগত ব্যাকরণের একাধিপত্যে প্রথম চিড় ধরে তখন, যখন ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২/৩ সেপ্টেম্বর উইলিয়াম জোন্স্ নামীয় এক প্রখ্যাত ভাষাচিন্তক কোলকাতার রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির অধিবেশনে ভাষণদান করেন। এই ভাষণের মাধ্যমে তিনি সংস্কৃত, গ্রিক এবং লাতিন ভাষাগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে এই তিন ভাষার ক্রিয়ামূল ব্যাকরণিক সূত্রে পরস্পর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কবদ্ধ। যে-কোনও ভাষাচিন্তকই এই ধারণায় উপনীত না হয়ে পারবেন না যে এগুলো এমন কোনও অভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত, বর্তমানে যার আর অস্তিত্ব নেই। এই বক্তব্যের পর থেকেই পাশ্চাত্য পন্ডিতেরা ব্যাপক সংস্কৃত-উৎসাহী হয়ে ওঠেন এবং বিভিন্ন ভাষার পারস্পরিক সম্পর্কসূত্র উদ্ঘাটনে ব্যাপৃত হয়ে পড়েন। এই অনুসন্ধান চলতে থাকে বিভিন্ন ভাষার প্রধানত শব্দকে কেন্দ্র করে। এই চর্চা আবর্তিত হতে থাকে একদিকে যেমন ভাষাসমূহের পারস্পরিক তুলনায়, অন্যদিকে ভাষাসমূহের বিবর্তনে। এভাবেই জন্ম হয় এমন এক ধারার, যার নাম ‘তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান’।
এই খন্ডে সংকলিত হলো মোট ত্রিশটি রচনা/রচনাংশ।