Arthoniti Chinta
Arthoniti Chinta

সম্পাদক পরিচিতি

অর্থনীতিচিন্তার খন্ড সমূহ

প্রাচীন বাংলা বিশেষ করে পঞ্চম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাঙালির অর্থনৈতিক জীবনের একটি সার্বিক রূপরেখা বা অবস্থান তুলে ধরার প্রয়াসই হল এই খন্ডের প্রধান উদ্দেশ্য। যেখানে প্রাচীন বাংলার কৃষি, শিল্প, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য, ভূমির মালিকানা অবস্থান এবং কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তি, মুঘল শাসনের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও কৃষকবিদ্রোহ সবিস্তারে স্থান পেয়েছে, যা আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণের শক্তিশালী উপাদান। আটটি অধ্যায় নিয়ে প্রথম খন্ড সাজানো হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে প্রাচীন বাংলার কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি সমৃদ্ধ চিত্র তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে কৃষিপ্রধান সভ্যতায় ভূমি ব্যবস্থা সমাজবিন্যাসের যে গোড়ার কথা - এই সত্যটি উঠে এসেছে দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘ভূমি-বিন্যাস’ আলোচনায়। তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে কৃষি ও শিল্প বিকাশের বিস্তারিত বিবরণ এবং শাসকশক্তির শোষণের বহুমাত্রিক চিত্র। অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ড স্থানীয় শাসনযন্ত্র সহায়ক ভূমিকা রাখত যা আমাদের লোকজ আর্থনীতিক জীবনে ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়। ইউরোপীয় বণিকশ্রেণি আসার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি সমাজ-সম্পর্কে যে বহুমাত্রিক ঘাত-প্রতিঘাত দেখা দেয় অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের আলোকেই তা উঠে এসেছে গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে। রাষ্ট্র এবং জায়গিরদার, মনসবদার, জমিদার ও কৃষকের ত্রিভুজ সম্পর্কের অবয়বে সৃষ্টি হয়েছিল মুঘল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। মুঘল যুগে কৃষি অর্থনীতিতে কৃষকবিদ্রোহ চিন্তার নতুন মাত্রা এনে দেয়। গোটা অষ্টাদশ শতাব্দীর বিশৃঙ্খলা, শাসন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া, আধিপত্য ও আনুগত্যের টানাপোড়েন ও পুঁজিবাদী বিকাশ না-হওয়াই মুঘলদের পতনের কারণ-এ কথাটাই এই অধ্যায়ে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। এই বিষয়টি সুনির্দিষ্ট অবয়ব পেয়েছে গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ে ‘মুঘল কৃষি ব্যবস্থা’ আলোচনায়। এভাবেই সামগ্রিক অর্থে প্রাচীন বাংলার অর্থাৎ পঞ্চম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোটা বাংলার অর্থনীতির চালচিত্র তুলে ধরার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে প্রথম খন্ডে।

১৮৫৭-র বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা একটি তাৎপর্যপূর্ণ মোড় নেয়। এই প্রক্রিয়ায় যে-সমস্ত ব্যক্তির ভাবনা-চিন্তা সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিল সে-সম্পর্কেই এখানে বিশদভাবে আলোচনা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র, বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী, সিদ্ধান্তগ্রহণকারী ও নীতিপ্রণেতা এবং তাদের শ্রেণিস্বার্থকেন্দ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনমতের উদ্ভব এবং উনিশ শতকের সত্তরের দশকে জাতীয়তাবাদভিত্তিক অর্থনৈতিক চিন্তার যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা বুঝতে এই খন্ডটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যে সময়টা নিয়ে এ খন্ডে পর্যালোচনা করা হয়েছে তা ছিল মূলত আধা-রাজনৈতিক স্তরের কূটচালের খেলা। এ সংঘাতের মধ্য দিয়েই একটি শহুরে উঠতি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকশিত হতে থাকে। এদের নেতৃত্বেই প্রধানত ভারতে ও বাংলায় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে।


এই খন্ড বাঙালির ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর অর্থনৈতিক ইতিহাস দিয়ে সাজানো হয়েছে। যেখানে রয়েছে এ সময়ের অভ্যন্তরীণ আন্তঃপ্রাদেশিক ও উপকূলবর্তী বাণিজ্য, কৃষিতে বর্গাব্যবস্থার উৎপত্তি, তার বিস্তার ও বর্গাদারদের সংগ্রামের কথা, বাংলায় শিল্পের বিকাশ, শিল্প-শ্রমিকদের সমস্যা ও শ্রমিকআন্দোলন এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক ব্যবসায় বাঙালির অবস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। ইউরোপের ‘নবজাগরণ’ বাঙালির জীবনচর্চায় গভীর প্রভাব ফেলে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অর্থনীতির ক্ষেত্রে এ প্রভাবের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার প্রয়াস তেমন লক্ষ করা যায় না। ঊনবিংশ এবং পরবর্তী বিংশ শতাব্দীতে জনসংখ্যা বেড়েছে, কৃষি ও শিল্পের বিকাশ ঘটেছে কিন্তু কৃষির স্থবিরতা কাটেনি। কৃষিতে সামন্তবাদী প্রথা ভেঙে ধনবাদের বিকাশ একচ্ছত্র হয়নি। এতে করে একটি মিশ্র অবস্থান লক্ষণীয়। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত রাজনৈতিক অবস্থানের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে এখানে; দেখা গেছে পূর্ব-ভারতে ব্রিটিশ বিনিয়োগের ৮০ শতাংশ আসে বাংলায়। তার পরেও বিকাশমান বাঙালি মধ্যবিত্তশ্রেণি অবয়বে পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। ব্রিটিশ বিনিয়োগ নীতি, তার কৃষি ও শিল্পনীতি বাংলার অনুন্নয়নের কারণ। এতে অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির চলকটি। যার স্বাভাবিক ফল হিসেবে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতেই আমরা লক্ষ করি কৃষকবিদ্রোহ ও শ্রমিকবিদ্রোহ। এ খন্ডের শেষদিকে ব্যাংক ব্যবসায় বাঙালির অবস্থান সম্পর্কিত একটি আলোচনা সংযুক্ত করা হয়েছে। ধারাবাহিক আলোচনায় আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার অবস্থান, তার সমস্যা ও সমাধানের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। খন্ডটিকে সমৃদ্ধ করেছে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের ‘বঙ্গবন্ধুর আর্থ-সামাজিক ভাবনা’ লেখাটি। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা, সমাজবোধ, অর্থনৈতিক ভাবনা-এ সবকিছুরই পটভূমি হিসেবে উদ্ভাসিত ছিল দেশের প্রতি মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর এক্সচেঞ্জ, সুব্রত গুপ্ত ও পরিমল চক্রবর্তীর রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তা, উপমহাদেশের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ভবানী সেনের অর্থনীতি-বিষয়ক কতিপয় লেখা, আবুল হুসেনের ফ্রেড্রিক লিস্ট ও তৎকালীন জার্মানি-বিষয়ক লেখা এবং শান্তিকুমার ঘোষের অমর্ত্য সেনের অর্থনৈতিক চিন্তা দিয়ে চতুর্থ খন্ড সাজানো হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হল গ্রাম। অর্থাৎ সমীকরণটা এমন যে কৃষির উন্নতি মানে কৃষকের উন্নতি। বাংলার চটকলের শ্রমিক আন্দোলনের অর্থনীতি, চোরাবাজারের আধিপত্য, বাংলার দুর্ভিক্ষ এবং কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ প্রভৃতি লেখায় ভবানী সেনের মার্কসবাদী বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি নয়, শুল্কপ্রাচীর, অগ্রাধিকার চিহ্নিত করা এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা শিল্পায়নকে প্রসারিত করবে। এই তত্ত্ব প্রকাশ করে জার্মানিকে শিল্পায়িত করেন ফ্রেড্রিক লিস্ট; অর্থাৎ কৃষি নয়-শিল্পের ওপর চাই অধিক গুরুত্ব। লেখক আবুল হুসেন মনে করেন লিস্টের তত্ত্ব ভারতবর্ষেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। ড. বিনায়ক সেন উৎপাদন পদ্ধতির বিচারে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধারার বিশ্লেষণ কাঠামো উপস্থাপন করেছেন। বিশেষ করে বাম রাজনৈতিক কর্মীদেরকে অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিচার-বিবেচনার চেয়েও গোটা রাজনৈতিক সংগ্রামের দিকে ঠেলে দেয়ার দিকটি তিনি তুলে ধরেন। সেবা ও স্বাচ্ছন্দ্য যোগাবার ব্যাপারে রাষ্ট্রকে চূড়ান্ত ভূমিকা নিতে হবে। তাই কেবল বণ্টনকেন্দ্রিক নীতি নয়, উৎপাদনভিত্তিক কৌশলকেও অবলম্বন করা দরকার। ‘অমর্ত্য সেনের অর্থনৈতিক চিন্তা’ প্রবন্ধে লেখক ড. শান্তিকুমার ঘোষ এ কথাগুলোই বলার চেষ্টা করেছেন।


নোবেলবিজয়ী অমর্ত্য সেন, ভবতোষ দত্ত, রেহমান সোবহান, মুহাম্মদ ইউনূস, অম্লান দত্ত এবং সনৎকুমার সাহার লেখা দিয়ে ‘বাঙালির অর্থনীতি চিন্তা’র ৫ম খন্ডটি সাজানো হল। অমর্ত্য সেনের লেখাগুলো ইংরেজি থেকে বঙ্গানুবাদ করে ভবতোষ দত্তের সম্পাদনায় ‘সিরিজ অর্থনীতি গ্রন্থমালা’র আওতায় গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা লেখাগুলো সেখান থেকেই সংগ্রহ করি। অধ্যাপক রেহমান সোবহানের লেখাগুলো নেয়া হয়েছে তাঁরই বই ‘বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার সংকট’ থেকে। আর অধ্যাপক ভবতোষ দত্তের প্রবন্ধসমূহও ‘সিরিজ অর্থনীতি গ্রন্থমালা’ থেকে নেয়া। চলমান সময়ের অর্থনীতি শিক্ষায় জনকল্যাণের মাপকাঠি অতি সংকীর্ণ অবস্থায় আছে। জনকল্যাণ-বিষয়ক অর্থনীতির অনিশ্চয়তা ও এর স্থায়ী সংকটের মূলে রয়েছে অর্থনীতির তথ্য-বিষয়ক সংকীর্ণতা। প্রয়োজনীয় তথ্যের সন্ধানে অর্থনীতি চর্চায় ছোট গন্ডি ছাড়িয়ে যে জনস্বাস্থ্য-চিকিৎসা, পুষ্টি বিজ্ঞান, জনসংখ্যা বিদ্যা ইত্যাদি বিষয়েরও সন্ধান করা দরকার, তারই প্রস্তাব রাখেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশ : পরনির্ভরতার প্রকৃতি’ - নিবন্ধে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্যে ক্রমবর্ধমান বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরতার ফলাফলকে পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করেছেন এবং ‘বাংলাদেশের বুর্জোয়াশ্রেণীর বিকাশ ও আভ্যন্তরীণ অসঙ্গতি’ নিবন্ধে বাঙালি বুর্জোয়া এবং তাদের পূর্বসূরিদের ইতিহাস আলোচনা করেছেন। পরনির্ভরতার পরিণতি যে কতখানি ভয়াবহ হতে পারে তার উদাহরণ পাওয়া যাবে তাঁর ‘খাদ্য ও দুর্ভিক্ষের রাজনীতি’ নিবন্ধে। মুহম্মদ ইউনূস বাংলাদেশ ২০১০ গ্রন্থে তার বাস্তববাদী, স্বাপ্নিক মানুষটিরই পরিচয় মেলে। আগামীতে তথ্যপ্রযুক্তির বিশাল সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে তিনি অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগসৃষ্টির কথা বলেছেন। ‘সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও দারিদ্র্য’ নিবন্ধে অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত দেখিয়েছেন, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলেও দারিদ্র্য কমছে না ভারতবর্ষে। এর কারণ হল সঞ্চয়ের অপচয় অর্থাৎ মজুদ বিনিয়োগের বৃদ্ধি। ‘প্রগতি এবং দারিদ্র্য’ নিবন্ধে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের চিত্র তুলে ধরে তিনি প্রশ্ন করেন কেন এমন হচ্ছে? ভারত ও আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দরের ওঠা-নামার একটি ঐতিহাসিক আলোচনা করেছেন ‘সোনা নিয়ে ভাবনা’ নিবন্ধে। এখানে সোনার দরের ওঠা ও নামা মুদ্রাস্ফীতির ওপর যে বিরূপ প্রভাব রাখে তা-ই আলোচিত হয়। পরিকল্পিত অর্থনীতির ও আশির দশকের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করেন ‘কস্মৈ দেবায়’ লেখাটিতে। ‘পরিত্রাণায় দুষ্কৃতাং’ লেখায় তিনি দেখিয়েছেন কালো টাকা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অবৈধতাকে বৈধতা দান করে শেষ বিচারে কালো টাকা নিয়ন্ত্রিত হয় না। এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবেও গোটা বিষয়টি বিশ্লেষিত হয়েছে। একই সঙ্গে বিদগ্ধ প্রাবন্ধিক সনৎকুমার সাহা’র দুটো প্রবন্ধ ‘তৃতীয় ভুবনে ঋণের ফাঁদ’ এবং খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ অম্লান দত্তের ‘উন্নয়নের তত্ত্ব ও ভবিষ্যৎ’ গোটা খন্ডটিকে সমৃদ্ধ করেছে।

এ খন্ডে স্থান পেয়েছে কামাল সিদ্দিকীর, “বাংলাদেশের গ্রামীণ দারিদ্র্য--স্বরূপ ও সমাধান, ‘বাংলাদেশের গ্রামীণ দারিদ্র্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, বাংলাদেশে ভূমিসংস্কার রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং হাসনাত আবদুল হাই-র ‘পল্লি বিকাশ’।” অবিভক্ত বাংলার ঔপনিবেশিক সময়ের শেষের দিকের কৃষি প্রযুক্তি ও কাঠামোগত উপাদানগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত করে উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা এবং প্রবৃদ্ধির ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে। পূর্ববাংলার কৃষির শ্রেণিবিন্যাস এবং পশ্চিমবঙ্গের কৃষির সঙ্গে তার কাঠামোগত পার্থক্য আলোচিত হয়েছে এখানে। গ্রামীণ দারিদ্র্যের স্বরূপ, দক্ষিণ এশিয়ার কতিপয় দেশের সঙ্গে তার তুলনামূলক অবস্থান এবং সমস্যা সমাধানের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে কামাল সিদ্দিকীর লেখায়। ‘পল্লি বিকাশ’ শীর্ষক গ্রন্থে পল্লি সমাজের উৎপত্তি, এর শ্রেণিবিন্যাস, রোমান সাম্রাজ্য পতনের পর দাস সমাজের বিলুপ্তি, সামন্তব্যবস্থার উত্থান, সামন্তপ্রভুর সৃষ্টি এবং সর্বোপরি ভারতবর্ষে সামন্ত ব্যবস্থার অনড় রূপটির সঙ্গে এশিয়ার উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন হাসনাত আবদুল হাই।


এই খন্ডটি বিভিন্ন লেখকের নিবন্ধ নিয়ে সাজানো হয়েছে। তবে মূল বক্তব্যের মধ্যে সমন্বয়সাধনের লক্ষ্যে নিবন্ধসমূহের বিন্যাসের বিষয়ের দিকে নজর রেখেই করা হয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক আত্মনির্ভর উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রপঞ্চসমূহের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ধারাটিই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে নিবন্ধসমূহে। এই খন্ডে লিখেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ, এম. এম. আকাশ, সেলিম জাহান, আতিউর রহমান, ড. গোলাম মহিউদ্দিন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান দেখিয়েছেন দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিকল্পনায় বৈদেশিক সাহায্য-নির্ভরতা ক্রম-হ্রাসের মাধ্যমে একটি উত্তরণকালীন উন্নয়নের যে চিন্তা করা হয়েছে, বাস্তবে তার ফল ফলেছে উল্টো, বরং চরম দারিদ্র্য বেড়েছে। অধ্যাপক এম এম আকাশ তাঁর লেখায় উপসংহার টেনেছেন এ বলে ‘অর্থনীতি হচ্ছে রাজনীতিরই ঘনীভূত প্রকাশ’। সুতরাং আজকে বাংলাদেশে একটি যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বই পারবে আত্মনির্ভর উন্নয়নের রাজনৈতিক প্রশ্নটির সমাধান করতে। কর কাঠামো, রেশন ব্যবস্থা, আয় বণ্টন, খাদ্য আমদানি নীতি মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকেই বিরূপভাবে প্রভাবিত করছে বলে সেলিম জাহান দেখিয়েছেন। তার মূল বক্তব্যই ছিল গ্রামীণ সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তন না আনা পর্যন্ত বর্তমান খাদ্যনীতি বুভুক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটাবে না। ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ শ্রেণিভিত্তিক স্তরসমূহের অবস্থান অনেকটা পিরামিডের সঙ্গে তুলনা করে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানটি বিশ্লেষণ করেছেন। ড. আতিউর রহমানের লেখায় যান্ত্রিক অর্থনীতি থেকে কল্যাণমূলক অর্থনীতি চর্চায় অর্থনীতিকে নিয়ে যাওয়ার রূপান্তর-প্রক্রিয়া আলোচিত হয়েছে। তিনটি পর্যায়ে এই আলোচনা স্থান পায়; ১. বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশ, ২. বাংলাদেশের অর্থনীতির ঐতিহাসিক বাঁকসমূহ এবং ৩. বিশ শতকের বাংলাদেশের অর্থনীতি : কতিপয় সূচকভিত্তিক আলোচনা। গ্যাট চুক্তি এবং নবরূপে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ঘকৃ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ড. গোলাম মহিউদ্দিন। ডাঙ্কেল প্রস্তাবের মূল বিষয় হল ৭টি; ১. বাজারে প্রবেশের অধিকার, ২. কৃষি, ৩. বস্ত্র, ৪. মেধা সম্পত্তির অধিকার, ৫. বিনিয়োগ পদক্ষেপ অধিকার, ৬. পরিসেবা এবং ৭. প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে এখানে। লেখক ক্ষুদ্রঋণ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা একুশ শতকের জন্যে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন। লেখকের বিশ্বাস, প্রযুক্তিমুখী শিক্ষাবিস্তার উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে মূলভিত্তি হয়ে দাঁড়াবে। অধ্যাপক রেহমান সোবহানের দ্বিতীয় নিবন্ধে দেখা যায় ৮০-র দশক জুড়ে তৃতীয় বিশ্বে অবাধ বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার বিস্তার-এর কথা। এ উদ্দেশ্যেই বিশ্বব্যাংকের ঋণদান ও আইএসএফ-এর কাঠামোগত সমন্বয় গ্রহণের উদ্যোগ চলে। তারপরেও দেখা গেছে মাত্র হাতে গোনা ৫-৬টি দেশ ব্যতিরেকে তৃতীয় বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর জন্য এসব ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি।

প্রধানত রাজনৈতিক অর্থনীতি-কেন্দ্রিক প্রবন্ধসমূহ দিয়ে সাজানো হয়েছে এই গ্রন্থ সংকলনটি। অর্থনীতিবিদসহ সমাজ বিজ্ঞানের প্রথিতযশা লেখকরা এখানে লিখেছেন। যেমন ড. অনুপম সেন, ড. আবু মাহমুদ, আনিসুর রহমান ড. সেলিম জাহান, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বদরুদ্দীন ওমর, সইফ উদ দাহার, ড. আকবর আলি খান, মুহাম্মদ ইউনূস ও ড. আবুল বারকাত প্রমুখ। প্রাক-ব্রিটিশ বাংলাদেশের অর্থনেতিক অবস্থান, ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে দ্রুপদ পুঁজিবাদের বিকাশ না হওয়া, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শোষণের চরিত্র, বাণিজ্যপুঁজির বিকাশ এবং শিল্পপুঁজিতে রূপান্তরিত না হওয়া, কেন্দ্র ও প্রান্ত সম্পর্ক শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে উপরিকাঠামোর সর্বস্তরে বিস্তারিত হওয়া, বুর্জোয়া বিকাশ তত্ত্বের ভ্রান্ত ধারণা, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক অর্থনীতি, বাঙালি উঠতি পুঁজিপতি শ্রেণির অভিলাশ, দান-খয়রাতের অর্থনীতির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং দুর্নীতির বহুমাত্রিক বিকাশ এবং প্রভাব ইত্যাদি বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় এই সংকলনটি সমৃদ্ধ। এখানে বলা হয়েছে বাজার অর্থনীতি একটি পন্থা যা নব্য নয়। নব্য হলো মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানবসম্পদের বিকাশ। সমাজে বৈষম্য থাকলে প্রতিযোগিতা অবাধ হবে না। বেসরকারিকরণ মানেই বাজার অর্থনীতি নয়। সরকারি একচেটিয়া থেকে বেসরকারি একচেটিয়া সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতিকারক। বাজার অর্থনীতি পৃথিবীর কোথাও অগ্রগতি আনতে পারেনি। সুতরাং সরকারকে নিষ্ক্রিয় রেখে বাজার অর্থনীতির কাম্যতা অর্জিত হবে না। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যদি কোনো বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে তবে আমরা তাকে সাধুবাদ জানাব।